কালাম মাথা চুলকে বলল, “আমাকে তো এমনিতেই বের করে দিয়েছে। একটা ঢেলা ছুড়ব নাকি সরকারি স্কুলের টিমে? মাথায় ঠিক করে লাগাতে পারলে—”
রুখসানা শীতল চোখে কালামের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আর একটা কথা বলেছ কি ঐ গাছটাতে বেঁধে রাখব। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একটা কথা বলে দ্যাখো–”
কালাম ভয়ে ভয়ে একবার রুখসানার মুখের দিকে তাকাল, তারপর মুখ বন্ধ করে ফেলল, এতদিনে সে জেনে গেছে রুখসানা একটি বাজে কথাও বলে না!
পথচারী দলের ছেলেমেয়েরা মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে লেবুর টুকরা মুখে দিয়ে একটু চুষতে-না-চুষতেই হুইসেল বেজে গেল। আবার খেলা শুরু।
পরের অংশটুকু হল একটা অত্যন্ত কঠিন খেলা। সরকারি স্কুলের দল বারবার বল নিয়ে এগিয়ে এল আর বারবার তাদের আটকে দেয়া হল। শক্ত রক্ষাব্যুহ তৈরি করে দাঁড়িয়ে রইল বাচ্চা বাচ্চা কয়েকটা ছেলেমেয়ে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তারা বড় হয়, বাসায় কাজ করে, পাতা কুড়িয়ে ঘরে আনে। মানুষের সম্মান ভালোবাসা কখনো পায়নি। আজকে হঠাৎ একমাঠ ভরা মানুষ তাদের পক্ষ হয়ে চিৎকার করছে কেমন করে তার অসম্মান করে?
অনেক চেষ্টা করেও তারা আটকে রাখতে পারল না, একটি গোল হয়ে গেল। সরকারি স্কুলের সেন্টার ফরোয়ার্ড বলটি দিল রাইট আউটকে, রাইট আউট হাফ ব্যাককে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। গোলকিপার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল ধরার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না, ততক্ষণে বল গোলপোস্টে ঢুকে গেছে। সরকারি স্কুলের ছেলেরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকে।
রুখসানা হাত তুলে সান্ত্বনা দেয়, এখনও তারা একগোলে এগিয়ে আছে, কোনোমতে আর কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারলে তারা জিতে যাবে।
আবার খেলা শুরু হল, সময় আর কাটতে চায় না। পথচারী স্কুলের ছেলেমেয়েরা সমস্ত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াল পাহাড়ের মতো দুর্ভেদ্য একটা রক্ষাব্যুহ তৈরি করল গোলপোস্টের সামনে। সরকারি স্কুল বল নিয়ে এগিয়ে এল বারবার, কিন্তু কিছুতেই ব্যুহ ভেদ করে যেতে পারল না। পাথরের দেয়ালে আঘাত করে মানুষ যেভাবে ফিরে আসে ঠিক সেভাবে ফিরে এল সরকারি স্কুলের দল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে থাকে, রুখসানা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে–আর কয়েক মিনিট, তাহলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাবে।
খেলাশেষের হুইসেল বাজামাত্রই সমস্ত মাঠের মানুষ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। বিশাল দেহ নিয়ে মির্জা মাস্টার নাচতে নাচতে ছুটে এলেন মাঠে, তার পিছু-পিছু প্রফেসর আলি, ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি। মার্থা রোজারিও আর রাণুদিদি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। চুনু মিয়া আর মহসিন পানির বোতল নিয়ে ছুটে গেল মাঠে, বাচ্চাদের ঘাড়ে তুলে নিল আনন্দে!
আনন্দটি অবিশ্যি খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল, কারণ মির্জা মাস্টার নাচতে নাচতে মাঠের মাঝখানে ছুটে এসে হঠাৎ নিঃশ্বাস আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে হাসপাতালে নিতে হল সেখান থেকে। অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল বেশ তাড়াতাড়ি, কিন্তু স্ট্রেচার করে তাঁকে তুলতে গিয়ে যোলোজন মুশকো জোয়ানের একেবারে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
.
প্রথমে খেলাটি জেতার পর সবাই ভেবেছিল পথচারী স্কুল বুঝি ফাঁইনাল সেমি ফাঁইনালে উঠে যাবে, গল্প উপন্যাসে সাধারণত সেরকমই হয়। কিন্তু এটা গল্প উপন্যাস নয়, তা-ই দেখা গেল পথচারী স্কুল খুব বেশি দূর এগুতে পারল না। প্রথম খেলার পর সবাই ভেবেছিল অন্তত কালামের বুঝি একটা শিক্ষা হবে, পরের বার উলটোপালটা কিছু করবে না, কিন্তু তার কোনো শিক্ষাই হল না। পরের খেলাতেও খেলার মাঝখানে একজনের পায়ের সাথে পা বাঁধিয়ে তাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল। যখন খুববেশি সুবিধে করতে পারল না তখন হঠাৎ তাকে জাপটে ধরে নাকের মাঝে একটা ঘুষি–একেবারে রক্তারক্তি অবস্থা! মনে হয় খেলাধুলার ব্যাপারটা সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
রুখসানা অবিশ্যি হাল ছেড়ে দেয়নি। সে এবারে ক্রিকেট খেলার একটা টিম তৈরি করছে। ছেলে এবং মেয়েদের নিয়ে।
.
পরিশিষ্ট
পথচারী স্কুলের এই গল্প আমি শুনেছি ফরাসত আলির কাছে (যখন তিনি আমাকে এই গল্প বলেছেন তখন ছিল শীতকাল, তার মুখে ছিল দাড়িগোঁফের জঙ্গল)। আমি প্রথম ভেবেছিলাম তিনি বুঝি বানিয়ে বানিয়ে বলছেন (আমি নিজে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প করি তাই সব-সময় সন্দেহ হয় অন্যেরাও বুঝি তাই করছে) কিন্তু দেখা গেল আসলে একটি অক্ষরও বানিয়ে বলেননি। শুধু তাই নয়, তাঁর পকেটে স্কুলের সবার ছবি ছিল। স্কুলঘর, শিক্ষক, শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী–সবার। কালামের একটা আলাদা ছবি ছিল, ঠিক ছবি তোলার সময় দুষ্টামি করে একটা লাফ দিয়েছে বলে ছবিটা ঝাঁপসা এসেছে, চেহারাটা বোঝা যায় না। মির্জা মাস্টারেরও একটা ছবি ছিল, একটাতে আঁটেনি বলে দুবারে তুলতে হয়েছে।
।ফরাসত আলি পথচারী স্কুলের আরও অনেক গল্প করেছেন, বিজ্ঞান পরীক্ষা নিয়ে সমস্যার গল্প, চুনু মিয়ার ভূতের ভয় পাওয়ার গল্প, হারুন ইঞ্জিনিয়ারের পানির ট্যাংকের গল্প, মহসিনের কম্পিউটারের পাগলামির গল্প আরও কত কী! সবগুলি এখানে লেখা হল না, তা হলে একটা বিশাল উপন্যাস হয়ে যাবে, আজকাল মানুষের বিশাল উপন্যাস পড়ার সময় কোথায়? তা ছাড়া মনে হয় তার সবগুলি মানুষ বিশ্বাসও করবে না, মনে করবে আমি বুঝি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।