খেলার প্রস্তুতি হিসেবে সবার জন্যে উজ্জ্বল রঙের জার্সি তৈরি করা হল। ছেলেদের জন্যে শার্ট, মেয়েদের জন্যে ফ্রক, সামনে বড় বড় করে লেখা পথচারী স্কুল, পিছনে খেলোয়াড়দের নম্বর।
পথচারী স্কুলের প্রথম খেলাটিই পড়ল সরকারি স্কুলের সাথে। সরকারি স্কুলের ফুটবল টিম অত্যন্ত শক্তিশালী টিম, বড় বড় অফিসারের দুধ মাখন গোশত ফলমূল খাওয়া ছেলেরা সেই স্কুলে পড়ে। তারা পড়াশোনাতে যেরকম ভালো খেলাধুলাতেও সেরকম ভালো। তাদের চেহারা ছবি কথাবার্তা আচার-আচরণও ভালো, কালাম বুঝতে পারল খেলায় জেতার সেটাই হচ্ছে একমাত্র উপায়। যেহেতু, ছেলেগুলি ভদ্রগোছের প্রথমেই কড়া কড়া কয়েকটা ফাউল করে তাদের ভয় দেখিয়ে দিতে হবে। ফাউল কীভাবে করতে হয় তার দলের ছেলেরা খুব ভালো করে জানে। মেয়েদের নিয়েই হচ্ছে মুশকিল–সেটার উপর রুখসানা কোনোরকম ট্রেনিং দেয়নি। শুধু যে ফাউল করা শেখায়নি তা-ই নয়, ফাউল না করার উপর দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বসেছে।
রুখসানা মেয়েদের যে-ক্ষতি করেছে কালাম সেটা পুনরুদ্ধার করার জন্যে একদিন বিকালে তাদের জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করল। দলের মেয়েদের ডেকে বলল, “আপা তোমাদের যেসব কথা বলেছে সেসব এখন ভুলে যাও। খেলায় যদি জিততে চাও আমার কথা শোনো।”
তেজি ধরনের মেয়েটা বলল, “কী কথা?”
“খেলায় জেতার জন্যে প্রথমে যে-জিনিসটা শিখতে হয় সেটা হচ্ছে ল্যাং।”
“ল্যাং?”
“হ্যাঁ, খেলা চলার পর যখনই দেখবে একজন খুব ভালো খেলছে তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে।”
তেজি ধরনের মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “ল্যাং মেরে ফেলে দেব?”
“হ্যাঁ। ব্যাপারটা মোটেও কঠিন না। মনে আছে আমি একদিন চুনু মিয়াকে ল্যাং মেরে ফেলেছিলাম?” কালাম নিজের গৌরবময় অতীতের কথা চিন্তা করে আনন্দে একগাল হেসে ফেলল।
তেজি ধরনের মেয়েটা বলল, “আমরা কখনো ল্যাং মারব না।”
“মারতেই হবে!” কালাম হাতে কিল দিয়ে বলল, “যদি দেখা যায় খেলায় গোলমাল হচ্ছে তখন সবচেয়ে ভালো প্লেয়ারটাকে আউট করে দিতে হয়! এমনভাবে ল্যাং মারতে হয় যেন পা ভেঙে বসে যায়। বসাতেই হবে।”
মেয়েরা মাথা নাড়ল, “কক্ষনো না।”
কালাম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক আছে আমার উপরে ছেড়ে দাও, আমি ল্যাং মেরে বসিয়ে দেব।”
যেদিন ফুটবল খেলা সেদিন রুখসানা তার ফুটবল টিম নিয়ে মাঠে হাজির হয়েছে। বাচ্চাগুলিকে আজকে চেনা যায় না, উজ্জ্বল লাল এবং সাদা রঙের জার্সিতে আজকে তাদেরকে আর আলাদা করে গরিব বাচ্চা বলে বোঝা যায় না। কালামকে পর্যন্ত দেখতে মনে হচ্ছে একটি সভ্যভব্য ছেলে, মেয়েদের কথা তো ছেড়েই দেয়া যাক। ফুটফুটে চেহারায় একেকটা মেয়েকে মনে হচ্ছে বুঝি ফুলপরী।
সরকারি স্কুলের ফুটবল টিমের কোচ পথচারী স্কুলের টিম দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “এই মে-মে-মে-মেয়েরা খেলবে?”
রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
“এরা খে-খে-খে-খেলতে পারে?” রুখসানা আরও মিষ্টি করে হেসে বলল, “পারে।”
সরকারি স্কুলের ফুটবলের শিক্ষক এতক্ষণে নিজকে সামলে নিয়েছেন, চোখমুখ লাল করে বললেন, “এটা কোন ধরনের ফাজলেমি?”
“কেন, কী হয়েছে?”
“আমি আপনাদের স্কুলের খেলার টিচারের সাথে কথা বলতে চাই।”
রুখসানা তখনও চেষ্টা করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, “আমিই খেলার টিচার।”
“আপনি? আপনি একজন মেয়েমানুষ।”
এবারে রুখসানার মুখ থেকে হাসি খানিকটা মুছে গেল, বলল, “তাতে কোনো সমস্যা আছে?”
“অবশ্যই আছে।” মানুষটি এবারে রেগেমেগে বলল, “মেয়েমানুষের জায়গা মাঠে-ঘাটে-ফুটবল ফিল্ডে না। মেয়েমানুষের জায়গা পাকঘরে। মেয়েমানুষ স্বামীর খেদমত করবে আর ঘর-সংসার করবে।”
রুখসানার মুখে যেটুকু হাসি ছিল এবারে সেটাও মুছে গেল। শক্তমুখ করে বলল, “যদি মেয়েরা অন্য কিছু করে তা হলে কী হয়?”
“কী হয় তো দেখতেই পাচ্ছেন–” লোকটা চিৎকার করে কথা বলার সময় খানিকটা থুতু বের হয়ে এল, সেই অবস্থাতেই বলল, “তা হলে মেয়েরা গোল্লায় যায়! আর তার দেখাদেখি আর অন্য দশটা মেয়ের মাথা খাওয়া হয়–আপনি যে রকম খাচ্ছেন!”
রুখসানার মুখ হঠাৎ একেবারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল, কিন্তু সে গলা খুব ঠাণ্ডা রেখে বলল, “এবারে আমার কী মনে হয় শুনবেন?”
লোকটি থতমত খেয়ে বলল, কী মনে হয়?”
“যে-মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি চিন্তাভাবনা আপনার মতো তার জায়গা হচ্ছে নর্দমা!” লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী বললেন?”
“আমার কথা বিশ্বাস হল না? এই দেখেন–” বলে কিছু বোঝার আগে রুখসানা এগিয়ে এসে মানুষটাকে ধরে কীভাবে কীভাবে জানি শূন্যে ছুঁড়ে দিল এবং সবাই অবাক হয়ে দেখল মানুষটা শূন্যে উড়ে গিয়ে কাছাকাছি একটা নর্দমাতে গিয়ে পড়ল। নর্দমার ময়লা কাদা ছিটকে এসে লোকটার চোখেমুখে লেগে তাকে দেখাতে থাকে একটি ভয়ের সিনেমার ভূতের মতো। লোকটার খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে কী হয়েছে, যখন বুঝতে পারল তখন হাঁসফাঁস করে নর্দমা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। রুখসানা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “মেয়েদের নিয়ে আবার যদি আজেবাজে কথা বলেন তা হলে পরের বার আপনাকে স্ট্রেচারে করে নিতে হবে।”
কালাম কাছেই দাঁড়িয়েছিল, তার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের আপার সাথে তেড়িবেড়ি করা ঠিক না। বন্দুক পিস্তল যেরকম লাইসেন্স করতে হয় আপার দুইটা হাতও সেইরকম লাইসেন্স করা আছে।”