শক্তসমর্থ মেয়েটি জেদি গলায় বলল, “কেন খেলব না?”
কালাম পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “শোনো! মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলতে চায়! হিঃ হিঃ হিঃ–”
রুখসানা জেদি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলল পথচারী স্কুলের ফুটবল টিম তৈরি হবে ছেলে আর মেয়ে দিয়ে।
খবরটি যখন স্কুলে প্রচারিত হল সবাই চোখ কপালে তুলে ফেলল। ফারুখ বখত বললেন, “ফুটবল টিমে মেয়ে? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”
ফরাসত আলি বললেন, “ডানপিঠে সব ছেলেদের মাঝে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা খেলবে? ব্যথা পেয়ে গেলে?”
মির্জা মাস্টার বললেন, ফুটবল ক্রিকেট এইসব খেলাই তুলে দেয়া উচিত। ঘরে বসে কেরাম খেলতে পারে। না হয় দাবা।
প্রফেসর আলী বললেন, “রুখসানা মেয়েটাই একটা সমস্যা। এই বয়সী মেয়েদের এরকম দায়িত্ব দেয়াই ঠিক না।”
মহসিন বলল, “একটা জিনিস বললেই তো হয় না, খেলার কমিটি মেয়েদেরকে মাঠে নামতে হবে ভেবেছেন? কক্ষনো না!”
রাণুদিদি মুচকি হেসে বললেন, “দেশের মানুষেরা কি রেডি আছে? এটা তো বিপ্লব!”
মার্থা রোজারিও মাথা চাপড়ে বললেন, “তার মানে আমার ওষুধের বাক্স নিয়ে এখন খেলার মাঠে মাঠে যেতে হবে।”
চুনু মিয়া কান চুলকাতে চুলকাতে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “মাইয়া লোজনের জায়গা হল পাকঘর। এর বাইরে যাওয়া ঠিক না।”
বিকেলবেলা স্কুলে ছুটির পর সব শিক্ষক খানিকক্ষণ একসাথে বসে কথাবার্তা বলেন। সেখানে রুখসানার সাথে সবার দেখা হয়ে গেল। রুখসানা বলল, “শুনেছেন সবাই, ফুটবল টিমটা ছেলে আর মেয়ে নিয়ে তৈরি করে ফেলেছি।”
সবাই মাথা নেড়ে বলল, “শুনেছি।”
“কী মনে হয় আপনাদের?”
ফারুখ বখত কিল দিয়ে বললেন, “গ্রেট আইডিয়া! আমরা সারা দেশকে দেখিয়ে দেব আমাদের মেয়েরা ছেলেদের থেকে এক আঙুল কম না! চমৎকার কাজ করেছ তুমি! কোনো তুলনা নেই। এরকম নতুন নতুন আইডিয়া না হলে কেমন করে হবে? শোনার পর থেকে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে আছি! চমৎকার! ফ্যান্টাস্টিক।”
রাণুদিদি বললেন, “মহসিন বলছিল ফুটবল খেলায় মেয়েদের নামানো নাকি আইন নেই–”
মহসিন টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “আইন না থাকলে আইন তৈরি করে নেব, ফাজলেমি নাকি?”
রুখসানা বলল, “আমি চিঠিটা দেখেছি, কোথাও লেখা নেই ফুটবল টিমে শুধু ছেলেরা খেলতে পারবে মেয়েরা খেলতে পারবে না।”
“ভেরি গুড!” প্রফেসর আলি তাঁর চশমা ঠিক করে বললেন, “দরকার হলে আমরা হাইকোর্টে যাব। সুপ্রিম কোর্টে যাব।”
চুনু মিয়া কান চুলকাতে চুলকাতে পিচিক করে জানালা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে বলল, “দুনিয়ার সত্যিকারের কাজ খালি মেয়েলোকেরাই করতে পারে–পুরুষমানুষ কোনো কামের না!”
ফুটবল টিমের প্রথম সমস্যাটা দেখা গেল প্রথমদিন বিকালবেলা, সবাই মিলে প্র্যাকটিস শুরু করার সাথে সাথে। কালামের নেতৃত্বে টিমের ছেলে খেলোয়াড়রা এসে গম্ভীর গলায় বলল, যে-দলে মেয়েরা আছে তারা সেই দলে খেলতে রাজি নয়। কালাম ফুটবল টিমের শক্ত প্লেয়ার, সে যদি খেলতে রাজি না হয় ফুটবল টিমের শক্তি অর্ধেক কমে যাবে কাজেই ব্যাপারটি গুরুতর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রুখসানাকে বিচলিত হতে দেখা গেল না, উদাস গলায় বলল, “কেউ খেলতে না চাইলে তাকে তো আর জোর করে খেলানো যায় না। তোমরা না খেলতে চাইলে নাই।”
কালাম থতমত খেয়ে বলল, “ফুটবল টিমের কি হবে?”
“যে কয়জন আছে সেই কয়জন নিয়েই টিম হবে।”
“কিন্তু আপা, মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে। বাংলা স্কুলের ছেলেরা কীরকম ফাউল করে জানেন?”
রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “মার খেলে খাবে। কিন্তু মার না খেয়ে কখনো কেউ বড় হয় না।”
“আপা আপনি বুঝতে পারছেন না–”
আমার বোঝার কোন দরকার নেই। তোমরা যদি টিমে থাকতে চাও মাঠের এই মাথা ওই মাথায় দুইবার দৌড়ে আস, আর যদি থাকতে না চাও বাড়ি চলে যাও, সময় নষ্ট কর না।
কালাম আবার চেষ্টা করল, “আপা মেয়েছেলেরা কখনো ফুটবল খেলে না।”
“এখন থেকে খেলবে! আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”
কালাম এবং তার দলবল বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাঠের এক কোণায় বসে বসে চোরাকাটা চিবুতে থাকল, রুখসানা তাদের পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মেয়েদের নিয়েই প্র্যাকটিস শুরু করে দিল।
সে মেয়েদের মাঠের মাঝে দৌড়ে নিয়ে বেড়াল, নানাভাবে বল কিক করিয়ে অভ্যাস করাল, একজন আরেকজনকে পাস দেয়া শেখাল, হেড করা শেখাল, বল কেটে নেয়া শেখাল, বল থামানো শেখাল, কর্নার কিক করা শেখাল এবং যেই মেয়েটি গোলকিপার হবে তাকে বল ধরা শেখাল। স্কুলের মাঠে মেয়েরা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে খেলছে দেখার জন্যে কিছুক্ষণের মাঝেই চারপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল।
কালাম এবং তার দলবল কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল রুখসানা দরকার হলে সত্যি সত্যি শুধু মেয়েদের নিয়েই খেলবে–এরকম মানুষের সাথে জেদ করে খুব লাভ নেই। তা ছাড়া মেয়েগুলিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা জানপ্রাণ দিয়ে খেলবে। মেয়েদের নিয়ে টিম হলেও টিমটা খুব খারাপ হবে না। খেলায় হেরে গেলে সব-সময় মেয়েদের দোষ দিতে পারবে, কোনোভাবে জিতে গেলে তো কথাই নেই, সব-সময় বলতে পারবে মেয়েদের নিয়েই হারিয়ে দিলাম, ছেলের টিম হলে তো কথাই ছিল না। কাজেই প্র্যাকটিসের শেষের দিকে একজন একজন করে কালাম এবং তার দলবল মাঠে নেমে এল।