“কেমন করে?”
রইসউদ্দিন তখন তাঁর স্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললেন, শুনে তাঁর স্ত্রী মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এখনও সময় আছে–
“কী সময়?”
“ফরাসত আলি সাদাসিধে মানুষ, এখনও নিশ্চয়ই খোঁজ পায়নি। দৌড়ে তার বাসায় গিয়ে দ্যাখো টিকেটগুলি কিনে আনতে পার কি না–”
“রইসউদ্দিন তখনই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বললেন, ঠিক বলেছ। তুমি ঠিক বলেছ।”
তিনি তখন লাফিয়ে উঠে কোনোমতে জামাকাপড় পরে ছুটলেন ফরাসত আলির বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী পিছন থেকে চিৎকার করে বললেন, “খালিহাতে যেও
খবরদার! দুই কেজি মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।”
ফরাসত আলি অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠে মাত্র এক কাপ চা তৈরি করে চুমুক দিয়েছেন ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। দরজা খুলে দেখেন তাঁর বন্ধু রইসউদ্দিন, হাতে মিষ্টির বাক্স। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আরে প্রফেসর সাহেব! কী মনে করে?”
রইসউদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, “এই তো মানে ইয়ে ভাবলাম অনেকদিন দেখা হয় না।”
“এই তো সেদিন দেখা হল, মনে নেই? লটারির টিকেট
“ও! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রফেসর রইসউদ্দিন অনেকবার মাথা নেড়ে বললেন, সেদিন তুমি বললে তাই ভাবলাম তোমার কাছ থেকে লটারির টিকেটগুলি কিনেই নিই।”
ফরাসত আলি খুশি হলে বললেন, “কিনবে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, কিনব।”
“কয়টা?”
“তুমি যদি বল তাহলে সবগুলি।”
“সবগুলি?” ফরাসত আলি একটু অবাক হলেন এবং তার হঠাৎ একটু সন্দেহও হল। জিজ্ঞেস করলেন, “সবগুলি কিনবে?”
“হ্যাঁ। এত একটা ভালো কাজের জন্যে লটারি।”
“কিন্তু সেদিন তুমি না বললে জাল?”
“জাল হলে হবে! রইসউদ্দিন উদারভাবে হেসে বললেন, ভালো কাজে জাল জুয়াচুরির ভয় করতে হয় না।
ফরাসত আলি বললেন, “ঠিক আছে তুমি যদি কিনতে চাও কেনো।” তিনি গিয়ে তার ভোশক তুলে দেখলেন টিকেটগুলি নেই। তখন মনে পড়ল দুদিন আগে তোশকগুলি রোদে দিয়েছিলেন, তখন লটারির টিকেটগুলি বের করে একটা বইয়ের মাঝে রেখেছিলেন। কোন বইয়ের মাঝে রেখেছিলেন সেটা এখন মনে করতে পারলেন না। ফরাসত আলি খানিকক্ষণ কয়েকটি বইয়ের মাঝে খুঁজে হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ধুর, এখন খোঁজাখুঁজি করতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বিকেলবেলা এসো আমি খুঁজে বের করে রাখব।”
রইসউদ্দিন ফরাসত আলির দুই হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “সত্যি? সত্যি?”
ফরাসত আলি একটু অবাক হয়ে বললেন, “সত্যি।
রইসউদ্দিন তখন তার পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে ফরাসত আলির হাতে দিয়ে বললেন, “এই যে, একটা টিকেট পাঁচ টাকা করে একশোটা টিকেটের জন্যে পাঁচশো টাকা।”
ফরাসত আলি টাকাটা খানিকক্ষণ হাতে রেখে আবার কী মনে করে রইসউদ্দিনকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “এখন দিতে হবে না, বিকালে দিও?”
রইসউদ্দিন খানিকক্ষণ ঝোলাঝুলি করে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন। ফরাসত আলি দরজা বন্ধ করে ফিরে আসছিলেন তখন আবার দরজায় শব্দ হল, দরজা খুলে দেখেন তার কাস্টমসের বন্ধু এমাজউদ্দিন। এমাজউদ্দনের হাতে একটা বিশাল রুইমাছ। ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, “আরে এমাজউদ্দিন, তুমি
এত বড় রুইমাছ নিয়ে কোথায় যাও?”
“তোমার কাছে এসেছি। ভাবলাম অনেকদিন দেখা নেই, একটু দেখা করে আসি।”
“কে বলল দেখা নেই? এই তো সেদিন দেখা হল!”
“তা বটে!” এমাজউদ্দিন একটু বোকার মতো হেসে হাতের মাছটা দেখিয়ে বললেন, “সস্তায় পেয়ে গেলাম মাছটা, তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।”
ফরাসত আলি বললেন, “কী আশ্চর্য! আজকে সবাই দেখি আমার জন্যে কিছু-না-কিছু নিয়ে আসছে!”
এমাজউদ্দিন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে বললেন, “আর কে এসেছে?”
“প্রফেসর রইসউদ্দিন।” এমাজউদ্দিন ছোট ছোট চোখ করে জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছিল?”
“লটারির টিকেট কিনতে।”
“তু-তু-তুমি দিয়ে দিয়েছ?”
“এখনও দিইনি।”
এমাজউদ্দিন একবারে হাতজোড় করে বললেন, “রইসকে দিও না, প্লিজ আমাকে দাও। আমি সবগুলি কিনে নেব ডবল দাম দিয়ে। এই দ্যাখো নগদ দিয়ে দিচ্ছি”
এমাজউদ্দিন পকেট থেকে টাকা বের করছিলেন ফরাসত আলি তাঁকে থামালেন, বললেন, “এখন দেয়ার দরকার নেই, বিকেলবেলা দিও। আমি আগে টিকেটগুলি খুঁজে বের করে রাখি।”
এমাজউদ্দিন ফরাসত আলির দুই হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “দেবে তো আমাকে টিকিটগুলি? দেবে তো?”
ফরাসত আলি চিন্তিত মুখে বললেন, “দেখি।”
এমাজউদ্দিন চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করার আগেই ফরাসত আলি দেখতে পেলেন ডাক্তার আবু তালেব আর অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। আবু তালেবের পিছনে একটা ছোট ছেলে, তার মাথায় একঝাঁকা কমলা। আব্বুল করিমের হাতে একটা প্যাকেট, প্যাকেটের ভিতরে কি বোঝা যাচ্ছে না তবে দোকানের নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে ভিতরে নিশ্চয়ই নতুন শার্ট। দুজনের মুখেই একধরনের বিগলিত হাসি এবং তারা কিছু বলার আগেই ফরাসত আলি টের পেয়ে গেলেন তারা কী বলবেন।
হঠাৎ করে তার একটা বিচিত্র সন্দেহ হতে শুরু করল।
.
ফারুখ বখত সবসময় খবরের কাগজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন, কিছুই ছেড়ে দেন না। হারানো বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষধ, মশাল মিছিল থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি সবকিছু তিনি খুব শখ করে পড়েন। তিনি কিছুই বাদ দেন না বলে লটারির টিকেট পর্যন্ত যেতে তার একটু দেরি হল কিন্তু যেই তিনি বিজয়ী টিকেটের নাম্বারটি পড়লেন তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নাম্বারটি দ্বিতীয়বার পড়ে তিনি চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলেন, তারপর খরের কাগজটা হাতে নিয়ে সেই অবস্থায় ফরাসত আলির বাসার দিকে ছুটতে শুরু করলেন। বড় রাস্তার মোড়ে এসে তার একটা স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল, তিনি বটা ফেলে এক পায়ে স্যান্ডেল পরে ছুটতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পর অন্য স্যান্ডেলের ফিতা খুলে গেল, তিনি তখন সেটা ছুঁড়ে ফেলে খালিপায়ে ছুটতে লাগলেন। স্কুলের কাছে এলে তার শার্ট একটা দোকানের ঝাঁপিতে লেগে পটপট করে সবগুলি বোতাম ছিঁড়ে গেল, তিনি হৃক্ষেপ করলেন না। বাজারের কাছে আসতেই ঘেয়ো কুকুরগুলি ঘেউঘেউ করে তাঁকে খানিকক্ষণ তাড়া করল, তিনি সেটা টেরও পেলেন না। দৌড়ে ফারুখ বখত যখন ফরাসত আলির বাসার কাছে পৌঁছালেন তখন তার লুঙ্গি খুলে এল। তিনি দুই হাতে লুঙ্গি শক্ত করে ধরে ছুটতে ছুটতে কোনোরকমে তার বাসায় পৌঁছলেন। ফরাসত আলির দরজা খোলা ছিল, তিনি ভিতরে ঢুকে দড়াম করে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লেন।