কালাম বলার চেষ্টা করল, আমি পড়তে পারি না। মুখ পাকাঁপাকি ভোলা থাকায় সেখান থেকে শুধুমাত্র আঁ-আঁ জাতীয় একটা শব্দ বের হল। মার্থা রোজারিও সেটা শুনেই তার কথা বুঝে ফেলার ভান করে বললেন, “কী বললে, কলম নাই? এই নাও কলম।”
কালাম কলম হাতে নিয়ে আবার আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করল সে পড়তে পারে না, মার্থা রোজারিও আবার বুঝে ফেলার ভান করে বললেন, “হাতের লেখা ভালো না? কোনো সমস্যা নেই। আমি খারাপ হাতের লেখাও পড়তে পারি।”
মার্থা রোজারিও মিষ্টি করে হেসে কালামকে কাগজ-কলম হাতে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। কালাম তার হাতের কাগজের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কাগজের অর্থহীন আঁকিবুকির মাঝে কী লেখা রয়েছে না জানার জন্যে এই প্রথমবার আফসোস হতে থাকে। মুখ ব্যথায় টনটন করছে, কতক্ষণ তাকে বসে থাকতে হবে এবং তারপর কী হবে চিন্তা করে তার কালঘাম ছুটতে থাকে।
মার্থা রোজারিও কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে এসে অবাক হবার ভান করে বললেন, “সে কী, এখনও কিছু লেখনি?”
কালাম মাথা নাড়ল। মার্থা রোজারিও বললেন, “ঠিক আছে, শুধু নামটা লেখো তা হলেই হবে। তোমার নাম তো কালাম, লেখো সেটা। আমি দেখিয়ে দিই।”
মির্জা মাস্টার প্রায় এক বত্সর চেষ্টা করে যাকে একটা অক্ষর শেখাতে পারেননি মার্থা রোজারিও কয়েক মিনিটে তাকে তার নিজের নাম লিখতে শিখিয়ে দিলেন। তাকে আরও অনেক কিছু শেখানো যেত কিন্তু মার্থা রোজারিও তার চেষ্টা করলেন না, বাচ্চাটির কষ্ট দেখে তার নিজেরও কষ্ট হতে শুরু করেছে। হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে মুখের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কোথায় জানি চেপে ধরতেই আবার কট করে শব্দ হল এবং সাথে সাথে কালামের চোয়াল দুটি খুলে গিয়ে মুখটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
কালাম তার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে কৃতজ্ঞ চোখে মার্থা রোজারিওর দিকে তাকিয়ে বলল, “জানটা বাঁচালেন আপনি। আমি ভাবছিলাম আর মুখ বন্ধ হবে না! কেমন করে করলেন?”
“পড়াশোনা করো, বড় হয়ে ডাক্তার হও তা হলে দেখবে কেমন করে করা যায়। যাও এখন।”
কালাম সাবধানে কয়েকবার মুখ বন্ধ করে এবং খুলে পরীক্ষা করে বলল, “আমাকে শিখিয়ে দেবেন?”
“কেমন করে মুখ আটকে গেলে খুলতে হয়?”
“না।”
“তাহলে কী?”
কালাম দাঁত বের করে হেসে বলল, “কেমন করে মুখ খোলা থাকলে আটকে দিতে হয়।”
“কেন?”
“তা হলে কী মজা হবে! আমি সবার মুখ খুলে আটকে রাখব। হি হি হি –সব মুখ হাঁ করে বসে থাকবে!”
মার্থা রোজারিও চোখ পাকিয়ে বললেন, “দুষ্ট ছেলে! আমি তা হলে তোমাকে দিয়েই শুরু করি! আসো আমার কাছে–”
.
সাধারণত গল্প উপন্যাসে এরকম সময় দুষ্ট ছেলেরা খুব ভালো হয়ে যায়। পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়ে ভালো ছাত্র হয়ে বড় হয়ে দেশের উপকার করে ফেলে। কিন্তু এটা যেহেতু সত্যি ঘটনা এখানে সেরকম কিছুই হল না, কালাম দুই থাকল। খেলার মাঠে সবাইকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে লাগল, ক্লাসে পাশে বসে থাকা ছেলেদের চিমটি কাটতে লাগল, পকেটে করে বিষপিঁপড়া এনে বন্ধুদের ঘাড়ে ছেড়ে দিতে লাগল, কোনো কারণ ছাড়াই ঝগড়া পাকিয়ে মারপিট করতে লাগল।
শুধু মির্জা মাস্টার খুব ছোট একটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন, কালাম শেষ পর্যন্ত পড়া শিখতে রাজি হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, কালাম স্বরবর্ণ শেষ করে শেষ পর্যন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে পা দিয়েছে। মনে হয় এভাবে থাকলে মাসখানেকের মাঝে পড়া শিখে যাবে।
০৭. গরমটা একটু কমে আসতেই
গরমটা একটু কমে আসতেই পথচারী স্কুলে একটা চিঠি এল। আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার চিঠি, অংশ নিতে হলে এক্ষুনি চিঠি লিখে তাদের জানাতে হবে। কয়েকজনের হাত ঘুরে চিঠিটা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছালো রুখসানার হাতে। পথচারী স্কুলের কোনো ফুটবল টিম নেই কিন্তু তাই বলে ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না সেটা তো হতে পারে না! রুখসানা চিঠি লিখে জানিয়ে দিল তার স্কুলের দুর্ধর্ষ ফুটবলের টিম নিয়ে সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসছে।
ফুটবল টিমটা কীভাবে তৈরি করবে সেটা নিয়ে কয়েকদিন ভাবনাচিন্তা করে রুখসানা একদিন খেলার মাঠে সব ছাত্রছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে বলল, “তোমরা কারা কারা ফুটবল টিমে নাম দিতে চাও?”
স্কুলের সব ছেলেমেয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। যাদের উৎসাহ বেশি তারা দুই হাত তুলে লাফাতে লাগল।
রুখসানা উৎসাহী অসংখ্য ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে কীভাবে তাদের মাঝে থেকে মাত্র এগারো বারোজন বেছে নেবে ভেবে পায় না। সাতপাঁচ ভেবে মাঠের মাঝখানে একটা বল রেখে বলল, “একজন একজন করে সবাই বলটাকে কিক করো, যারা সবচেয়ে দূরে নিতে পারবে তাদের মাঝে থেকে টিম তৈরি করা হবে। একেকজনের তিনটা করে চান্স!”
দেখা গেল সবচেয়ে দূরে যারা বল কিক করেছে তাদের মাঝে ছয়জন মেয়ে।
কালাম মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, “মেয়েলোক কি ফুটবল খেলে? ফুটবল হচ্ছে পুরুষলোকের খেলা! খামাখা বলটাকে এত জোরে লাথি মারলে কেন?”
শক্তসমর্থ একটা মেয়ে কালামকে মুখ ভেংচে বলল, “ইচ্ছে হয়েছে মেরেছি! পরেরবার আরও জোরে মারব।”
রুখসানা গলায় হুইসেল ঝুলিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছিল, কালাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, মেয়েদের সরিয়ে রাখেন না কেন? তারা তো ফুটবল খেলবে না।”