কালামের জন্যে যে-মানুষটির কাজকর্ম খুব বেড়েছে তিনি হচ্ছেন মার্থা রোজারিও। প্রত্যেক দিনই কিছু ছেলেমেয়েকে তার কাছে হাজির করা হয় যাদের হাত বা পায়ের ছাল উঠে গেছে, খানিকটা চুল ছিঁড়ে এসেছে, নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পা মচকে গেছে–কখনো কখনো আরও বেশি, এক কান দিয়ে কিছু শুনছে কিংবা ডান পায়ে কোনো অনুভূতি নেই! এই সমস্ত রোগীর বেশিরভাগই কালামের নিজের হাতে তৈরি করা, তারা হয় কালামের নানা ধরনের পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছে কিংবা তার দ্বৈতযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। মার্থা রোজারিও মোটামুটিভাবে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আছেন, এই ছেলেটিকে কীভাবে ঠিক করা যায় তিনি ভেবে পান না। পড়াশোনা শেষ করে কোনোদিন স্কুল থেকে পাস করে বের হয়ে যাবে তার কোনো আশা নেই, খোঁজ নিয়ে শুনেছেন সে এখনও স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর ‘অ’-তে আটকে আছে।
মির্জা মাস্টার যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে পড়াশোনার ব্যাপারটি কালামকে বোঝানো সম্ভব নয় এবং তাকে তার স্বাধীন জীবনেই ছেড়ে দিতে হবে তখন একটা ছোট ঘটনা ঘটল। ঘটনাটি এরকম :
প্রতিদিন সকালে কালামকে স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর ‘অ’ পড়িয়ে পড়িয়ে তিনি মোটামুটি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাই সেদিন তাকে দ্বিতীয় অক্ষর ‘আ’ শেখানোর চেষ্টা করবেন বলে ঠিক করলেন। ব্ল্যাকবোর্ড বড় করে আ লিখে তিনি কালামকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোন অক্ষর?”
কালাম মাথা চুলকে এবং ঘাড় ঘুরিয়ে নানাভাবে অক্ষরটি পরীক্ষা করে মাথা চুলকে বলল, “আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে দুইটা বাঁশগাছের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তবে ছবিটা বেশি ভালোই হয় নাই, বাঁশগাছ আরও লম্বা হয়।”
মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “এইটা বাঁশগাছ না। এইটা আ। বলো আমার সাথে, ‘আ’।
যে-কোনো ব্যাপার নিয়ে দুষ্টুমি করা কালামের অভ্যাস। কাজেই এবারেও সে দুষ্টুমি করে বিশাল বড় হাঁ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, “আ।”
ঠিক তখন সে শুনল তার কানের কাছে কোথায় জানি কট করে একটা শব্দ হল। শুধু তা-ই না, মুখটা ভোলা অবস্থাতে আটকে গেল, আর বন্ধ হল না।
মির্জা মাস্টার ধমক দিয়ে বললেন, “মুখ হাঁ করে বসে আছ কেন? বন্ধ করো।”
কালাম মিছেই তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না, . চোয়ালের কাছে কোথায় জানি পাকাঁপাকি ভাবে কী একটা আটকা গেছে। এই মুখ আর বন্ধ হবে না। হঠাৎ করে, জীবনের প্রথম সে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে।
মির্জা মাস্টার আবার ধমক দিলেন, “মুখ বন্ধ করো।”
কালাম নাক এবং গলা দিয়ে আঁ আঁ জাতীয় একটা শব্দ করে মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল সে মুখ বন্ধ করতে পারছে না। মির্জা মাস্টার হঠাৎ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে তার কাছে এলেন, চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হয়েছে? মুখ বন্ধ হচ্ছে না?”
কালাম মাথা নাড়ল।
”সর্বনাশ!”
ততক্ষণে ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরেছে। দার্শনিকের মতো একজন গম্ভীর গলায় বলল, “আল্লাহ শাস্তি দিয়েছে স্যার। কালাম সাংঘাতিক পাজি–আল্লাহ সেজন্যে নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছে।”
ফরসা করে ফুটফুটে একটা মেয়ে কালামের মুখের ভিতরে তাকিয়ে বলল, “দাঁত মাঝে নাই। দাঁতে পোকা হয়েছে স্যার।”
কালামের দাতে পোকা দেখার জন্যে তখন আরও কয়েকজন তার কাছে এগিয়ে এল। একজন চোখ উজ্জ্বল করে বলল, “দ্যাখ দ্যাখ কালামের আলজিহ্বা দেখা যাচ্ছে!”
তখন কালামের মুখের ভিতরে তার আলজিব দেখার জন্যে আরও অনেক ভিড় করে এল।
দার্শনিকগোছের ছেলেটি আবার তার মাথা নেড়ে বলল, “আল্লাহর কাছ থেকে কেউ ছাড়া পায় না। কালাম এই মুখ দিয়ে গালি দেয় দেখে আল্লাহ মুখের মাঝে শাস্তি দিয়েছে। মুখ আর কোনোদিন বন্ধ হবে না।”
ছোটখাটো একজন উৎসুক ছেলে বলল, “হাত দিয়েও তো মারে, হাতে কিছু হবে না?”
দার্শনিক ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলল, “হবে। হাতপা ভেঙে লুলা হয়ে যাবে। তখন সিনেমা হলের সামনে এসে ভিক্ষা করতে হবে। আল্লাহ কাউকে ছাড়ে না।”
একটি মেয়ে অনেকক্ষণ কালামকে লক্ষ করে বলল, “রাত্রে ঘুমালে মুখে যদি ইঁদুর ঢুকে যায়?”
মির্জা মাস্টার ধমক দিয়ে সব বাচ্চাকে সরিয়ে দিয়ে কালামকে নিয়ে ছুটলেন স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিওর কাছে।
মার্থা রোজারিও কালামকে একনজর দেখেই ব্যাপারটা বুঝে গেলেন, এটি খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। মুখের ঠিক জায়গায় চাপ দিয়ে খুব সহজেই আটকে যাওয়া চোয়াল খুলে যায়, কিন্তু তিনি এই অমূল্য সুযোগ এত সহজে হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। কালামকে ঘরের কোণায় একটা চেয়ারে বসিয়ে মির্জা মাস্টার এবং অসংখ্য উৎসাহী দর্শককে বিদেয় করে দিলেন।
মুখ হাঁ করে বসে থাকতে থাকতে কালামের মুখের আশেপাশে ব্যথা করতে শুরু করছে। ব্যাপারটি কী সেটা নিয়ে ভয়টুকু তাকে কাবু করছে আরও বেশি। এটি সত্যি যদি আল্লাহর শাস্তি হয়ে থাকে এবং ধীরে ধীরে হাতপা ভেঙে লুলা হয়ে তাকে যদি সিনেমা হলের সামনে বসে ভিক্ষা করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয় তখন কী হবে ভেবে সে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিল না।
ভিতরে ভিতরে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়েও মার্থা রোজারিও মুখে হাসি ফুটিয়ে একটু পরে কালামের কাছে ফিরে এলেন, তার হাতে একটা ফর্ম। কালামকে ফর্মটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও, ফর্মটা ফিলআপ করো। নাম ঠিকানা বয়স, কী সমস্যা লিখে নিচে পড়ে পড়ে ঠিক জায়গায় টিক চিহ্ন দিতে থাকো।”