কালাম খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলে, “দেখে নৌকার মতো মনে হয় স্যার। কিন্তু ছবিটা ভালো হয় নাই। একটা পাল দেয়া দরকার ছিল।”
মির্জা মাস্টার তখন হুংকার দিয়ে বলেন, “এইটা নৌকা না, এইটা ‘অ’।
কালাম তখন তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে, “মনে পড়েছে স্যার। এটাই। অ। অ অ অ।”
পরের দিন দেখা যায় আবার সে ভুলে গেছে।
স্কুলের পড়াশোনার অংশটা কালামের একেবারেই ভালো লাগে না, তবু সে মোটামুটি নিয়মিত আসে, কারণ পড়াশোনা ছাড়াও সেখানে আরও নানারকম দুষ্টুমি করা যায়। সে একেকদিন একেকজনের পিছনে লাগে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শেষ করে সে এখন বড়দের ধরেছে। গত কয়েকদিন সে যার পেছনে সময় ব্যয় করছে সে হচ্ছে চুনু মিয়া। চুনু মিয়া প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা বাচ্চাদের খাবারের জন্যে একঝাঁকা রুটি এবং এক গামলা শবজি নিয়ে আসে। সেদিন কালামের কী মনে হল কে জানে হঠাৎ করে চুনু মিয়ার পায়ের মাঝে নিজের পা ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তাল হারিয়ে চুনু মিয়া আছাড় খেয়ে পড়ল, তার শবজি উঠে গেল আকাশে এবং নিচে নেমে আসার সময় সেগুলো এসে পড়ল তার শরীরে। তাকে দেখাতে লাগল বিশাল আধ-খাওয়া একটা শিঙাড়ার মত।
চুনু মিয়া মেঝে থেকে কোনোমতে উঠে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে কালামকে ধরার চেষ্টা করল। তাকে ধরতে পারলে কী হত কেউ জানে না, কিন্তু তাকে ধরা গেল না। কিছুক্ষণের মাঝেই খবর পৌঁছে গেল ক্লাস টিচার মির্জা মাস্টারের কাছে এবং মির্জা মাস্টার কালামকে ডেকে পাঠালেন। মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কালাম তুমি চুনু মিয়াকে ল্যাং মেরেছ?”
কালাম মাথা চুলকে বলল, “জি স্যার মেরেছি।”
“কেন মেরেছ?”
“কেমন জানি লোভ হল স্যার। কারও ঠ্যাং দেখলেই আমার ল্যাং মারার ইচ্ছে করে। পায়ের মাঝে কুটকুট করতে থাকে স্যার।”
“পায়ের মাঝে কুটকুট করে?” মির্জা মাস্টার হুংকার দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু বেশি অবাক হয়েছিলেন বলে হুংকারে জোর হল না। বললেন, “খবরদার
আর যদি পা কুটকুট করে ভালো হবে না কিন্তু। আর ল্যাং মারবে?”
কালাম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মির্জা মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “মারবে?”
“জানি না স্যার। হঠাৎ করে লোভ লেগে যায়, তখন স্যার”
“খবরদার তুমি আর চুনু মিয়ার ধারে কাছে আসবে না। চুনু মিয়াকে তুমি আর ছুঁতে পারবে না।”
কালাম একগাল হেসে বলল, “ঠিক আছে স্যার, আমি আর চুন্ন চাচাকে ছোঁব!”
কাজেই কালাম পরের দিন অসতর্ক চুনু মিয়ার পায়ের সামনে একটা কলার ছিলকে ফেলে দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিল, আগের দিন থেকে অনেক
জোরে। চুন্নু মিয়া যখন তার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলার জন্যে তাকে স্কুলের করিডোরে ধাওয়া করতে লাগল, কালাম তারস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ছুঁই নাই, আমি ছুঁই নাই। খোদার কসম ছুঁই নাই!–”
যে-বিষয়টিতে কাউলার অল্পকিছু উৎসাহ দেখা গেল সেটি হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সূত্রে তার সেরকম উৎসাহ নেই–তার উৎসাহ শুধুমাত্র ধ্বংসাত্মক দিকটিতে। রাণুদিদিকে সে যেসব প্রশ্ন করল সেগুলি এরকম:
বোমা বানানো কি খুব কঠিন?
ইলেকট্রিক শক দেওয়ার কোনো যন্ত্র কি আবিষ্কার হয়েছে?
ছাদের উপর থেকে নিচে কারও মাথায় ঢেলা ফেললে কী হয়?
চিমটি দিলে ব্যথা লাগে কেন?
অদৃশ্য হয়ে যাবার কোনো ওষুধ কি আবিষ্কার হয়েছে?
কারও চায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলে কী হয়?
চুলে আগুন ধরিয়ে দিলে বোটকা গন্ধ কেন বের হয়?
বিজ্ঞানের প্রতি কালামের এই গভীর ভালোবাসা দেখে রাণুদিদির যতটুকু খুশি হওয়ার কথা ছিল খুব সংগত কারণে তিনি সেরকম খুশি হলেন না, বরং তাকে খুব চিন্তিত দেখা গেল!
রাণুদিদি বরাবরই তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদেরকে হাতেকলমে বিজ্ঞান শিখিয়ে এসেছেন। ক্লাসে কালামকে আবিষ্কার করার পর থেকে হঠাৎ করে হাতেকলমে বিজ্ঞান শেখানো ব্যাপারটি তিনি ভয় পেতে শুরু করেছেন। যেমন ধরা যাক, বিদ্যুৎ পরিবাহী এবং অপরিবাহী ব্যাপারটি। যেদিন তিনি ক্লাসে বললেন পানি হচ্ছে বিদ্যুৎ পরিবাহী, তিনি আতঙ্কিত হয়ে দেখলেন সাথে সাথে কালামের মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠল। রাণুদিদি চোখ পাকিয়ে বললেন, “কালাম, তুমি দাঁত বের করে হাসছ কেন?
“বিজ্ঞানের একটা পরীক্ষা করব সেটা চিন্তা করে আনন্দ হচ্ছে।”
“কী পরীক্ষা?”
কালাম মাথা নেড়ে বলল, “এখন বলা যাবে না।”
“কেন বলা যাবে না?”
“এখন বললে আপনি জেনে যাবেন, তাহলে আর কোনো মজা থাকবে না?”
রাণুদিদি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং দেখা গেল তাঁর দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। পরের দিন কম্পিউটারের শিক্ষক মহসিন মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে এসে জানাল কালাম এক বালতি লবণগোলা পানি এনে তার কম্পিউটারের মাঝে ঢেলে দিয়েছে। সে নাকি পানির বিদ্যুৎ পরিবাহিতা হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখছিল। কম্পিউটারের মনিটর থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়ে এসে একটা বিতিকিচ্ছির ব্যাপারে ঘটেছে। কালামকে জোর করে কম্পিউটার শেখানোর ফলে এরকম হলে সে ভুলেও এই পথে পা মাড়াত না!
কালামের একমাত্র সাফল্য দেখা গেল অঙ্ক ক্লাসে। পাইকারি দোকান থেকে কলা কিনে রেলগাড়ি কিংবা বাসস্টেশনে খুচরো বিক্রি করে করে সে সংখ্যা এবং যোগ-বিয়োেগ খুব ভালো শিখে গেছে। তবে যে-কোনো সমস্যার উত্তর সে টাকাতে দিয়ে থাকে। যেমন, তাকে যখন বলা হয়”করিমের কাছে চারটি বই, রহিমের কাছে তিনটি বই, মোট কতটি বই?” কালাম উত্তরে বলে সাত টাকা! অঙ্কের ঘাঘু শিক্ষক প্রফেসর আলি কালামের মাথা থেকে টাকা রোগ সরিয়ে সাধারণ ছাত্রে পালটানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু এখনও খুব লাভ হয়নি। লাভ হবে সেরকম মনে হয় না।