ফরাসত আলি সাধারণত ঠাট্টা-তামাশা করেন না, আজকে তিনিও লোভ সামলাতে পারলেন না, বাম চোখটা একটু ছোট করে বললেন, “মানুষ যেরকম করে লেখে, কুকুর হইতে সাবধান’–আমরা সেরকম করে লিখে দেব, ‘জেলফেরত হইতে সাবধান।
ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত একে অন্যকে জাপটে ধরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলেন, কিন্তু অন্য চারজন তার মাঝে এতটুকু রসিকতাও খুঁজে পেলেন না।
০৬. অনেকদিন পার হয়ে গেছে
এর মাঝে বেশ অনেকদিন পার হয়ে গেছে। প্রথমদিকে যেরকম সবার ধারণা ছিল ছোট ছোট বাচ্চারা হবে জ্ঞানপিপাসু এবং তারা দিনরাত পড়াশোনা করে কয়েকদিনের মাঝেই সবাই একেকজন ছোটখাটো আইনস্টাইন হয়ে বের হয়ে আসবে দেখা গেল সেটা সত্যি নয়। রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করে বড় হওয়া বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জীবন সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ অন্যরকম। তারা সবাই জানে এই স্কুলের পুরো ব্যাপারটা বড়লোক কয়েকজন মাথা-খারাপ মানুষের খেয়াল। কয়েকদিন পরে তাদের এই খেয়াল ছুটে যাবে এবং তারা তখন আবার আগের মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াবে। কাজেই পথচারী স্কুলের ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী এটাকে একটা খেলা হিসেবে নিয়ে সময় কাটাতে আসছে। তবে রীতিমতো আসার জন্যেই হোক বা শিক্ষকদের উৎসাহের জন্যেই হোক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রায় সবাই মোটামুটি পড়তে শিখে গেছে। কেউ-কেউ ছোটখাটো ইংরেজি পড়তে পারে, কখনো কখনো বলতেও পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই বিদ্যাটি ঠিক কী কাজে লাগবে সে-সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
কাজেই পথচারী স্কুলে যারা পড়ান তারা সবসময় সবাইকে পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে মোটামুটি সব বাচ্চাকেই পড়াশোনার গুরুত্ব খানিকটা বোঝানো গেছে–কয়েকজন ছাড়া। তাদের মাঝে যে এক নম্বর তার নাম কাউলা। কাউলা যে কারও নাম হতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার কথা না। তবে তাকে দেখে কেউ যদি তার নাম অনুমান করার চেষ্টা করে সম্ভবত কাউলা নামটিই অনুমান করবে, কারণ এই ছেলেটির গায়ের রং কুচকুচে কালো।
রাণুদিদি প্রথম দিনেই কাউকে কাউলা নামে ডাকতে অস্বীকার করলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, “একটি বিশেষণ কার নাম হতে পারে না।”
কাউলা মাথা চুলকে রাণুদিদির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল রাণুদিদি তাকে বকাবকি করছেন কি না এবং যদি বকাবকি করে থাকেন তা হলে তার কারণটা কী। পরিষ্কার কিছু বুঝতে না পেরে সে দুর্বলভাবে বলল, “কিন্তু আমারে সবাই ডাকে কাউলা।”
“ডাকুক। তাতে কিছু আসে যায় না। কে তোমার এই নাম দিয়েছে? তোমার বাবা?”
“আমার বাবা নাই।”
“তা হলে মা?”
“আমার মাও নাই।”
“তা হলে তোমার এই নামের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তোমাকে আমি নতুন নাম দেব। বলল, তোমাকে কী নামে ডাকব?”
ক্লাসে ফাজিল ধরনের একজন বলল, “ময়লা।”
নামটি সত্যি হতে পারত, তাই পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে ওঠে। কাউলা ঘুষি পাকিয়ে ফাজিল ছেলেটিকে একবার হুমকি দিয়ে রাণুদিদির দিকে তাকাল। রাণুদিদি হাসি গোপন করে বললেন, “না, ময়লাও কারও নাম হতে পারে না। তার কারণ দুটো। এক : এটাও বিশেষণ। দুই : কোনোদিন যদি সে সাবান দিয়ে স্নান করে ফেলে তা হলে কী হবে?”
কাউলার নামটি কী হতে পারে সেটি নিয়ে খানিকক্ষণ গবেষণা হল এবং তার নতুন নামকরণ করা হল কালাম, আগের নামের কাছাকাছি যেন অভ্যস্ত হতে বেশি সময় না নেয়।
কালাম অত্যন্ত চালাক-চতুর ছেলে। তার সত্যিকারের বয়স কেউ জানে না, দেখে মনে হয় আট থেকে দশের মাঝে হবে। এই বয়সের একটা ছেলে যে এত চালু হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। সে যে-কোনো চলন্ত বাসে উঠে বিনা ভাড়ায় যে-কোনো জায়গায় চলে যেতে পারে, ট্রেনের ছাদে বসে সারা দেশ ঘুরে আসতে পারে। চলন্ত লঞ্চ কিংবা স্টিমার থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে চলে আসতে পারে। মাথায় বোঝা নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াতে পারে, পাইকারি দোকান থেকে এককাঁদি কলা কিনে তিনগুণ দামে বিক্রি করে ফেলতে পারে। প্রয়োজন হলে সে হাত বাঁকা করে নুলো শিশুর ভঙ্গি করে নাকি সুরে ভিক্ষা করে কিছু অর্থোপার্জন করে ফেলতে পারে। তার মতো মারপিট বা গালিগালাজ এই এলাকায় কেউ করতে পারে না এবং শুধুমাত্র এই কারণেই এই এলাকার যাবতীয় বাচ্চারা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। এতরকম গুণ থাকার পরও পড়াশোনা নামক অত্যন্ত সহজ বিষয়টিতে সে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। কাগজে অর্থহীন আঁকিবুকি করে কেন সেটা দেখে সবাই অর্থহীন শব্দ করে সেটাকে পড়াশোনা নাম দিয়েছে সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একধরনের কৌতুক ছাড়া আর কিছু না!
প্রতিদিন সকালে কালামকে নিয়ে একধরনের ধস্তাধস্তি হয়। মির্জা মাস্টার বলেন, “কালাম, তুমি বলো। পড়াশোনা কেন করতে হয়?”
কালাম মাথা চুলকে বলে, “স্যার ভুলে গেছি।”
মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বলেন, “ভুলে গেছি মানে? এক্ষুনি বলো।”
কালাম মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, “পড়াশোনা করলে মনে হয় চোখে কম দেখে। তখন চশমা পরতে হয়। আর চোখে চশমা থাকলে সবাই সালাম দেয়।”
মির্জা মাস্টার তখন হাল ছেড়ে দিয়ে ব্লকবোর্ডে একটা বড় ‘অ’ লিখে বলেন, “এইটা কী?”