স্কুলকে ঠিক করে বসাতে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন মির্জা মাস্টার। মই বেয়ে বেয়ে ক্লাস ঘরে ওঠা এবং আড়াআড়ি দরজা দিয়ে খুব সাবধানে ক্লাস ঘরে ঢুকতে এবং বের হতে হতে তিনি ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছেন। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকও খুব খুশি হলেন, খাড়া উপরে উঠে যাওয়ার স্কুলঘরটা সবসময়েই দুলতে থাকত, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হওয়া খুব সহজ নয়।
স্কুলের তদন্ত করার জন্যে সরকারি অফিসার এলেন বেলা এগারোটার দিকে। তখন ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত দুজনেই বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের সাইনবোর্ডটা নতুন এক জায়গায় লাগাচ্ছিলেন। স্কুলটি এখন আর খাড়া লম্বা হয়ে উঠে যাচ্ছে না বলে সেটাকে উঁচু বাঁশে করে উপরে ঝুলিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। সরকারি অফিসারটিকে ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলিকে চেনেন না, কিন্তু সাথে রইসউদ্দিন, তালেব আলি, আব্বুল করিম আর এমাজউদ্দিনকে দেখে চিনে ফেললেন। তারা যখন স্কুলঘরের কাছে এসেছে তখন তাদের মুখ মাছের মতো করে একবার খুলছে এবং বন্ধ হচ্ছে। গতকালকে বিকালেও তারা দেখেছে স্কুলটি উলটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখন ম্যাজিকের মতো সোজা হয়ে গেছে! নিজের চোখকেও তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। সরকারি অফিসার এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে এমাজউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথায় সেই স্কুল?”
এমাজউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “এ-এ-এ এইটাই সেই স্কুল।”
“এটা উলটো কোথায়? এটা তো ঠিকই আছে।”
“তা-তা-তা তাই তো দেখছি। কা-কা-কা কাল বিকালেও উলটো ছিল।”
সরকারি অফিসার চোখ পাকিয়ে এমাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন, রেগে গিয়ে বললেন, “আমার সাথে মশকরা করেন?”
“না স্যার, ম-ম-ম মশকরা না! সত্যিই ছিল। কালকেই উলটো ছিল। খো খো-খো খোদার কসম!”
“চুপ করেন।“ সরকারি অফিসার প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, “আল্লাহ খোদাকে টেনে আনবেন না এখানে। গাঁজা খেয়ে হাঁটাহাঁটি করেন, নাকি চোখে দেখেন না?”
ধমক খেয়ে এমাজউদ্দিন একেবারে কুঁকড়ে গেলেন, দেখে মনে হতে লাগল মাটির মাঝে মিশে যেতে চাইছেন কোনোভাবে। সরকারি অফিসার তখন অন্য তিনজনের দিকে তাকালেন, চোখ পাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কী বলার আছে?”
রইসউদ্দিন মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক বুঝতে পারছি না, কিছু একটা গোলমাল আছে কোনোখানে।”
“গোলমাল তো আছেই, সেটা তো আমি জানি। নিজের চোখে দেখছি। চমৎকার একটা স্কুলের পিছনে লেগেছেন সবাই মিলে–অভিযোগ করে দিলেন স্কুলটা খাড়া আকাশে উঠে গেছে। এত সুন্দর স্কুল দেখেছেন আগে?”
ডাক্তার তালেব আলি বারকয়েক চেষ্টা করে বললেন, “আ-আ-আমরা মিথ্যা কথা বলছি না স্যার, সত্যিই স্কুলটা উলটো ছিল।”
“চুপ করেন–” সরকারি অফিসার বাজখাই গলায় একটা ধমক দিয়ে বললেন, “স্কুলঘর কি কেউ রাতারাতি শুইয়ে দিতে পারে? সেটাই আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?” অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম ঢোক গিলে বললেন, “স্যার, আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।”
“চুপ করেন আপনি,” সরকারি অফিসার প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করব না অন্যের কথাকে বিশ্বাস করব? আমি কি আপনাদের মতো গাঁজা খেয়ে হাঁটাহাঁটি করি?”
অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম মাছের মতো খাবি খেতে লাগলেন। সরকারি অফিসার পকেট থেকে কী একটা কাগজ বের করে সেখানে ঘসঘস করে কী লিখে চোখ তুলে চারজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি দেখে নেব আপনাদের চারজনকে। হিংসা করে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাকে হেড অফিস থেকে টেনে এনেছেন। আমাকে ভেবেছেন কী আমার সময়ের কোনো দাম নেই? আমি কি আপনাদের মতো চব্বিশ ঘণ্টা চুকলামি করে বেড়াই? নাকি লাফাংরামি করে বেড়াই?”
চারজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সরকারি অফিসার হুংকার দিয়ে বললেন, “আপনাদের আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।”
এইরকম সময় ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একটু এগিয়ে এলেন। সরকারি অফিসার চোখ পাকিয়ে বললেন, “আপনারা আবার কারা?”
ফারুখ বখত একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমরা এই স্কুলটা চালাই, একটু ভিতরে এসে দেখতে চান স্যার? চালচুলোহীন বাচ্চারা কী সুন্দর পড়তে শিখেছে! একটু বড় যারা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করতে পারে। ইংরেজি পড়তে পারে।”
সরকারি অফিসার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনকে দেখিয়ে বললেন, “এই চারজন গাঁজাখোর মানুষের সাথে কথা বলে আমার দিনটাই নষ্ট হয়ে গেছে, হলে সত্যি আমি যেতাম।”
“ভিতরে গেলে আপনার দিনটা হয়তো ভালো হয়ে যাবে।”
“নিশ্চয়ই যাবে, অবশ্যিই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এই নিষ্কর্মা মানুষগুলির কথায় এতদূর থেকে এখানে এসে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে আর আসতে চাই না। আরেকদিন সময় নিয়ে আসব।”
“অবশ্যই আসবেন স্যার।”
সরকারি অফিসার লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে গিয়ে একটা জিপে উঠে চলে গেলেন।
রইসউদ্দিন, তালেব আলি, আব্বুল করিম আর এমাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে লাগলেন। দেখে মনে হতে লাগল তারা পারলে একজন আরেকজনকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবেন।
ফারুখ বখত মুখ টিপে হেসে বললেন, “তোমরা যখন জেলের ভাত খেয়ে ফিরে আসবে তোমাদের কোনো চাকরিবাকরি থাকবে না। যদি কাজ চাও আমার কাছে এস। আমাদের স্কুলের দারোয়ানের চাকরি দিয়ে দেব!”