ডাক্তার তালেব আলি বললেন, “একটা স্কুল উলটো করে দাঁড় করিয়ে রেখেছ, তদন্ত করতে এসে সেটা যখন দেখবে তোমাদের কোনো উপায় আছে বের হবার?”
প্রফেসর রইসউদ্দিন হিহি করে হেসে বললেন, “স্কুলের মেঝে উঠে গেছে আকাশে, দরজাগুলি আড়াআড়ি, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল বের হয়ে এসেছে দেয়াল থেকে, ফাজলেমির তো একটা মাত্রা থাকা দরকার!”
এমাজউদ্দিন নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে বললেন, “আর সেই স্কুলের ছাত্র কারা? এলাকার যত গুণ্ডাপাণ্ডা বখা ছেলেপিলে। রিকশাওয়ালার ছেলে! চোর-চামারের ছেলে। ছেঃ!”
ফারুখ বখত ফরাসত আলির হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে এলেন। রাস্তায় নেমে ফরাসত আলি বললেন, “আসলে তুই ঠিকই বলেছিলি।”
“কী?”
“ঘুষি মেরে দাঁতগুলি ভেঙে দেয়া উচিত ছিল।”
.
সন্ধ্যেবেলা ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি খুব মন-খারাপ করে তাদের ঘরে বসেছিলেন। এখনও তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না যে কোনো মানুষ শুধুমাত্র হিংসা করে তাদের এত সুন্দর একটা স্কুলের পিছনে লাগতে পারে। তারা যখন বসে বসে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছিলেন ঠিক তখন হারুন ইঞ্জিনিয়ার এসে হাজির হলেন, তাঁদের এভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন, “কী হল, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে ছেলে মরে গেছে?”
ফরাসত আলি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অবস্থা অনেকটা সেরকমই।”
“কেন? কী হয়েছে?”
ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত তখন পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন। সব শুনে হারুন ইঞ্জিনিয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে?”
“চিন্তা করার কিছু নেই? কী বলছ? যদি স্কুল বন্ধ করে দেয়?”
“স্কুল ঠিক করে ফেলো, তা হলে বন্ধ করবে না। উলটো স্কুল সোজা করে বসিয়ে ফেলো–আমি কতদিন থেকে বলছি!”
“সময় কোথায়? কালকেই আসবে তদন্ত করতে।”
“অনেক সময় আছে। এক রাতে পুরো স্কুল খুলে আমরা লাগিয়ে দেব। মনে নেই আগেরবার কীরকম একটা ঝড়ের রাতে পুরো স্কুল বসিয়ে দিয়েছিলাম? সেই তুলনায় আজকে কী চমকার রাত! পরিষ্কার জোছনা। দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
“সত্যি পারবে? সত্যি?” উত্তেজনায় ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি উঠে দাঁড়ালেন।
“না পারার কি আছে! এখন তো কাজ আরও সহজ। ইচ্ছে করলে নিচের ক্রুগুলি খুলে পুরো স্কুলঘরটা নামিয়ে দেব। এক ঘণ্টায় কাজ শেষ।”
“তাহলে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই, চলো কাজ শুরু করে দিই।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার উঠে দাঁড়ালেন, “চলো। চুনু মিয়াকে ডেকে আনতে হবে, সাথে মহসিন আর রুখসানা। দুজনেই খুব কাজের মানুষ। তোমরা সবাইকে নিয়ে যাও। আমি কিছু যন্ত্রপাতি, চার্জার লাইট, কপিকল, নাইলনের দড়ি এইসব নিয়ে আসছি।”
ঘণ্টাখানেকের মাঝেই জোছনারাতে সবাই কাজ শুরু করে দিলেন। কয়েকটা চার্জার লাইট জ্বালানো হয়েছে। এক পাশে একটা কেরোসিনের চুলায় বড় কেতলিতে পানি গরম হচ্ছে চা তৈরি করার জন্যে। কাছাকাছি কোথাও একটা ক্যাসেট-প্লেয়ারে ভাওয়াইয়া গান হচ্ছে, কাজ করার সময় এরকম গান চমৎকার শোনায়।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার বগলে কিছু কাগজ নিয়ে কাজকর্ম দেখছেন, অন্য সবাই কাজ করছে। প্রথমে ভেবেছিলেন পুরো স্কুলঘরটাই কাত করে নামিয়ে নেবেন, সাতপাঁচ ভেবে সেটা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটা একটা করে ঘর খুলে নেয়া হচ্ছে, কপিকলে বেঁধে সাবধানে সেটা নামিয়ে নেয়া হচ্ছে, তারপরে ঠেলেঠুলে সেটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে মাটিতে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। অসংখ্য বড় বড় স্কু, মস্ত বড় রেঞ্জ দিয়ে খুলে ফেলছে সবাই, আবার নতুন জায়গায় গিয়ে লাগিয়ে ফেলছে। সত্যিকারের কাজ খুব বেশি নয়, কিন্তু নানারকম খুঁটিনাটি ব্যাপার হয়েছে, এইসব খুঁটিনাটির ব্যাপারেই সময় বেশি চলে যাচ্ছে। হারুন ইঞ্জিনিয়ারের হিসেবে রাত একটার মাঝে কাজ শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু কাজ শেষ হতে হতে ভোররাত হয়ে গেল।
সারারাত কাজ করে কারও গায়ে আর কোনো জোর অবশিষ্ট নেই। বাসায় ফিরে গিয়ে যে যেখানে জায়গা পেল শুয়ে টানা ঘুম।
ফারুখ বখত কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই উঠে পড়লেন, আজ তার স্কুল তদন্তের জন্যে লোক আসার কথা। সেই লোকজন আসার আগেই তিনি স্কুলে চলে যেতে চান। দাড়ি কামিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে তিনি ফরাসত আলিকে ডেকে তুললেন। তারপর দুজন কিছু খেয়ে গরম দুই কাপ চা খেয়ে স্কুলে ছুটলেন।
এতদিন স্কুলটা খাড়া উপরে উঠে গিয়েছিল, এখন সেটা নিচে নেমে এসেছে বলে দেখতে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু স্কুলঘরগুলি দেখাচ্ছে চমৎকার, দেখে কে বলবে এটা এক রাতের কাজ? ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত অবাক হয়ে দেখলেন, এই সাতসকালেই সবাই এসে হাজির হয়েছে। মহসিন তার কম্পিউটারগুলি ঠিক করে সাজিয়ে রাখছে। চুনু মিয়া হাতে ন্যাকড়া নিয়ে ঘরের দরজা-জানালা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে। রুখসানা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে দুটি গোলপোস্ট বসাচ্ছে, কিছুদিনের মাঝেই ফুটবলের সিজন শুরু হবার কথা।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এল একটু পরেই, তাদের খাড়া স্কুল হঠাৎ চিত হয়ে শুয়ে আছে দেখে তারা এত অবাক হল বলার নয়। ছোট বাচ্চারা নতুন কিছু খুব পছন্দ করে তাই তাদের খুশি দেখে কে। নতুন ধরনের স্কুল সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল।