“ডাক্তার সাহেব আছেন?”
“জি আছেন। আসেন আমার সাথে।”
মেয়েটার পিছুপিছু একটা ঘরে ঢুকে দেখেন সেখানে ডাক্তার তালেব আলির সাথে আছে প্রফেসর রইসউদ্দিন, অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম আর কাস্টমসের এমাজউদ্দিন। চারজন মাথা কাছাকাছি রেখে কী-একটা গল্প করতে করতে খিকখিক করে হাসছিলেন। এই দুজনকে দেখে তাঁরা ভূত দেখার মতো চমকে
উঠলেন। প্রফেসর রইসউদ্দিন বললেন, “তো-তো তোমরা?”
“হ্যাঁ।” ফারুখ বখত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন, “অনেকদিন খোঁজখবর নেই তোমাদের।”
ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে গিয়ে থুতনি চুলকে ফেলে বললেন, “স্কুল নিয়ে খুব ব্যস্ত, অন্য কিছুতে সময় পাই না।”
তাঁর বন্ধুরা কিছু না বলে মাছের মতো চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরাসত আলি কিছু বলার না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা ভালো আছ?”
তার বন্ধুরা কথা না বলে মাথা নাড়লেন, সম্ভবত ভালোই আছে। তারপর আবার সবাই চুপ করে বসে রইলেন, বোঝা গেল তাদের মাঝে কথাবার্তার বিশেষ কিছু নেই।
এভাবে বেশ খানিকক্ষণ সময় কেটে যাবার ফারুখ বখত ঠিক করলেন কাজের কথা শুরু করবেন। একটু কেশে বললেন, “আমরা একটু কাজে তোমাদের কাছে এসেছি।”
“কী কাজ?”
“তোমরা তো নিশ্চয়ই জান আমরা গরিব বাচ্চাদের জন্যে একটা স্কুল খুলেছি, তাদের বেশির ভাগ এমনিতে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় বলে নাম দিয়েছি পথচারী স্কুল। বাচ্চাদের ফ্রি পড়ানো হয়, খাওয়া দেয়া হয়, দরকার হলে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?”
“কী?”
“কিছু মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এরকম একটা ভালো জিনিসের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে!”
ফারুখ বখত বললেন, “পৃথিবীতে কত বিচিত্র ধরনের মানুষ আছে! এরা নিশ্চয়ই হিংসুটে মামলাবাজ বদমাইশ আর খচ্চর প্রকৃতির।”
হঠাৎ করে রইসউদ্দিন, আবু তালেব, এমাজউদ্দিন আর আব্বুল করিম অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসলেন। ফারুখ বখত বললেন, “মানুষগুলির দেখা পেলে ঘুষি মেরে মনে হয় দাঁত খুলে নিতাম, কিন্তু দেখা পাওয়া মুশকিল। এরা পিছন থেকে চাকু মারে।”
ফরাসত আলি বললেন, “যা-ই হোক বদমাইশ মানুষ নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, আমরা এসেছি অন্য কাজে।”
অনেকক্ষণ পর অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম একটা কথা বললেন, “ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?”
“যারা অভিযোগ করেছে তাদের মাঝে আছে একজন শিক্ষাবিদ, একজন আইনজীবী, একজন ডাক্তার আর একজন সরকারি কর্মচারী। তোমরা চারজনও ঠিক সেরকম। এখন তোমরা যদি একটা পালটা চিঠি লিখে বল আসলে স্কুলটাতে কোনো সমস্যা নেই। চমৎকার স্কুল, এলাকার গরিব শিশুদের উপকার হচ্ছে, তা হলে হয়তো সরকারি লোকজনের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হবে।”
ডাক্তার তালেব আলি একটা ম্যাচ বের করে সেটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বললেন, “কত দেবে?”
ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, “কত কী দেবে?”
“টাকা।”
“টাকা?”
“হ্যাঁ, তিরিশ লাখ টাকা শুধু তোমরা দুইজন মিলে উড়িয়ে দিচ্ছ, আমাদের কিছু দেবে না?”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালেন। প্রফেসর রইসউদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের জন্যে একটা কাজ করে দেব, টাকা দেবে না? টাকা ছাড়া কাজ হয় আজকাল?”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। শেষে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কত চাও?”
“দশ লাখ।”
“দশ লাখ?”
“হ্যাঁ।” অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম মাথা নাড়লেন।
“একটা চিঠি লিখে দেবার জন্যে দশ লাখ? কবিগুরু সঞ্চয়িতা লিখেও দশ টাকা পাননি।”
“সেটা তোমাদের বিবেচনা।”
ফারুখ বখত উঠে দাঁড়ালেন, মাথা নেড়ে বললেন, “না, এই ধরনের কাজ টাকাপয়সা দিয়ে করানো ঠিক না। দশ লাখ দূরে থাকুক দশ টাকা দিয়েও করানো ঠিক না। শহরে আরও অনেক মানুষ আছে তারা খুশি হয়ে চিঠি লেখে দেবে।”
রইসউদ্দিন মুখ বাঁকা করে হেসে বললেন, “অন্য মানুষের চিঠি আর আমাদের চিঠির মাঝে একটা পার্থক্য আছে।”
“কী পার্থক্য?”
“অভিযোগের প্রথম চিঠিটা লিখেছিলাম আমরা।”
“তোমরা!” ফরাসত আলি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা?”
“হ্যাঁ। এতগুলি টাকা এইভাবে নষ্ট করছ চোখে দেখা যায় নাকি? একটা দুইটা মিনিবাস কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিতে, তা না করে স্কুল দিয়েছ! তাও যদি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল হত বড়লোকের বাচ্চাদের জন্যে তা হলেও একটা কথা ছিল!”
ফারুখ বখত বললেন, “ঘুষি মেরে তোমাদের চারজনের দাঁত খুলে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না তাই কিছু করলাম না।”
ফরাসত আলি বললেন, “মাথা-গরম করে লাভ নেই। আয় যাই এখান থেকে।”
তারা ঘর থেকে বের হবার আগেই কাস্টমসের অফিসার এমাজউদ্দিন বললেন, “যাবার আগে একটা কথা শুনে যান।”
“কী?”
“কালকে আপনাদের স্কুল তদন্ত করতে আসবে।”
“কালকে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“পুরো ব্যাপারটা আমরা দাঁড় করালাম আর আমি জানব না? হে হে হে। যা-ই হোক, হাতে নগদ ক্যাশ টাকা রেখো।”
“নগদ ক্যাশ টাকা?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কেন সেটা এখনও জান না? তোমার নাক টিপলে মনে হয় এখনও দুধ বের হয়।”
ফারুখ বখত ফরাসত আলির হাত ধরে টেনে বললেন, “আয় যাই এখান থেকে।”
অ্যাডভোকেট আব্বুল করিম বললেন, “আমার কথাটা একটু ভেবে দেখলে পারতে হে. খরচ কম পড়ত।”