মার্থা রোজারিও ছুটে গেলেন চুনু মিয়ার কাছে, বুকে পিঠে কান লাগিয়ে বললেন, “এখনও বেঁচে আছে।”
ফারুখ বখত বললেন, “থাকলে থাকুক, সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আগে দেখি ফরাসত আলিকে ছুটিয়ে আনতে পারি কিনা।”
ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে এসে চুনু মিয়াকে ঘিরে দাঁড়াল, কমবয়সী একটা মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “কী মজা হচ্ছে আজ! তাই না?
অন্য সবাই মাথা নাড়ল, সত্যিই আজকে খুব মজা হচ্ছে।
০৫. ফরাসত আলিকে থানা থেকে উদ্ধার
ফরাসত আলিকে থানা থেকে উদ্ধার করে আনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। চুনু মিয়া কয়েকদিন আড়ালে আড়ালে ছিল–কিন্তু ফরাসত আলি নেহায়েৎ ভালো মানুষ–চুনু মিয়ার উপরে সেরকম রেগে যাননি বলে সে এখনও চাকরিতে বহাল আছে। পথচারী স্কুলের কাজকর্ম মোটামুটি ভালোই চলছে, যারা পড়াচ্ছে বা কাজ করছে সবাই তাদের কাজে বেশ অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। ঠিক এরকম সময়ে একটা চিঠি এল। হলুদ রঙের খামে একটা সরকারি চিঠি। খামটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু ভিতরের চিঠিটা পড়ে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
চিঠির উপরে নানা ধরনের সংখ্যা, তারিখ এবং কটমটে লেখা, সরকারি চিঠিতে যেরকম থাকে। কাগজের মাঝামাঝি জায়গা থেকে চিঠি শুরু হয়েছে। ওপরে সম্বোধন নেই, তার বদলে লেখা, যাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চিঠিটা এরকম।
এতদ্বারা জানানো যাইতেছে যে, গণপূর্ত বিভাগে স্থানীয় এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চিকিৎসক আইনজীবী এবং সরকারি কর্মচারীবৃন্দ এই মর্মে অভিযোগ করিয়াছেন যে অত্র অঞ্চলে একটি বেআইনি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইয়াছে। শিক্ষাদানের পটভূমিকায় এই প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিপজ্জনক স্থান এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের উপর হুমকিস্বরূপ।
কেন এই বেআইনি প্রতিষ্ঠানটিকে অত্র অঞ্চল হইতে সম্পূর্ণরূপে অপসারিত করা হইবে না, পত্রপাঠমাত্র সেই সম্পর্কে অত্র বিভাগকে অবহিত করিবার জন্য নির্দেশ দেয়া হইতেছে।
চিঠি এইখানে শেষ, তার নিচে নানা ধরনের সংখ্যা এবং চিহ্ন এবং একজন মানুষের স্বাক্ষর। স্বাক্ষরটি ইংরেজি বাংলা বা আরবি যে-কোনো ভাষায় হতে পারে–দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই।
চিঠি পড়ে ফারুখ বখত বললেন, “সর্বনাশ!”
ফরাসত আলি কিছু না বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরকম সময়ে তিনি দাড়ি চুলকাতে থাকেন, এখন সে-চেষ্টা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন মুখমণ্ডল চাঁছাছোলা এবং তখন তিনি নিজের দাড়ি এবং চুলের জন্যে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, “কী লিখেছে চিঠিতে?”
ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে খুব খারাপ চিঠি।”
ফরাসত আলি বললেন, “আমাদের দেশে বাংলা ভাষা চালু হয়ে গেছে না? সরকারি চিঠি বাংলায় লেখার কথা না?”
ফারুখ বখত গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা বাংলা চিঠি।”
“বাংলা নাকি?” ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে কিছু বুঝতে পারলি না। কেন?”
“সরকারি চিঠি পড়ে কিছু বোঝা যায় না!”
“আবার পড় দেখি! আস্তে আস্তে পড়িস।”
ফারুখ বখত আস্তে আস্তে পড়লেন, কয়েকটা শব্দ এবারে আগের থেকে বেশি বোঝা গেল কিন্তু তবু অর্থ পরিষ্কার হল না। তারা আন্দাজ করলেন কিছু একটা জিনিস বেআইনিভাবে করা হচ্ছে।
ফরাসত আলি চিঠিটা নিয়ে আরও কয়েকবার পড়লেন এবং ধীরে ধীরে হঠাৎ চিঠির অর্থ পরিষ্কার হতে শুরু করল। এই এলাকার কোনো কোনো মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে পথচারী স্কুল খুব বিপজ্জনক কাজেই স্কুলটা তুলে দেয়া হোক। তাঁদের এরকম চমৎকার একটা স্কুলের বিরুদ্ধে কেউ যে অভিযোগ করতে পারে সেটা ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত বিশ্বাস করতে পারলেন না। তারা অনেকক্ষণ চিঠির দিকে মনমরা হয়ে তাকিয়ে রইলেন, শেষে ফারুখ বখত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এই স্কুলের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছে তারা হচ্ছে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক আর সরকারি কর্মচারী। আমরা যদি পালটা একটা চিঠি পাঠানোর চেষ্টা করি যেখানে একজন করে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক আর সরকারি কর্মচারী লিখে দেয় যে স্কুলটা খুব ভাল তা হলে কেমন হয়?”
ফরাসত আলি বললেন, “আইডিয়াটা মন্দ না। কিন্তু পাব কোথায় এরকম মানুষ?”
“কেন, আমাদের রইসউদ্দিন হচ্ছে অঙ্কের প্রফেসর, তাকে শিক্ষাবিদ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। অ্যাডভোকেট আব্বুল করিমকে আইনজীবী বলে চালিয়ে দেব। ডাক্তার তালেব আলি হবে চিকিৎসক আর আমাদের কাস্টমসের এমাজউদ্দিন হবে সরকারি কর্মচারী। কী বলিস?”
ফরাসত আলির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মাথা নেড়ে বললেন, “তা-ই তো, এই সহজ জিনিসটা আমার আগে মনে হয়নি। কী আশ্চর্য!”
ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “লটারির টিকেট নিয়ে যে-ব্যাপারটা হয়েছিল সেটা কি মনে রেখেছে নাকি কে জানে!”
ফরাসত আলি হাত নেড়ে বললেন, “ধুর, এসব কি কেউ মনে রাখে নাকি? তা ছাড়া আমার কতদিনের বন্ধু। আমাদের বিপদে সাহায্য করবে না?”
“তা তো করবেই। নিশ্চয়ই করবে।”
“তা হলে চল যাই, কবে যাবি?”
“আজ বিকালেই চল।”
সেইদিনই বিকালবেলা তারা তাদের বন্ধুর বাসায় রওনা দিলেন। অঙ্কের প্রফেসরের বাসায় গিয়ে দেখলেন কেউ নেই, সেখান থেকে গেলেন ডাক্তার তালেব আলির বাসায়। দরজায় শব্দ করতেই কাজের মেয়েটি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চান?”