ফারুখ বখত গিয়ে ছোট ভ্যান ডি গ্রাফ যন্ত্রের মডেলটির সুইচ অন করে দিলেন, সাথে সাথে ঘড় ঘড় শব্দ করে সেটা চালু হয়ে গেল। কালো রঙের একটা বেল্ট ঘুরতে থাকে কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সামনে বসে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল, “স্যার স্থির বিদ্যুৎ কোথায়?”
ফারুখ বখত মাথা চুলকালেন। তিনি নিজেও জানেন না স্থির বিদ্যুৎটি কোথায়, অনিশ্চিতের মতো ভ্যান ডি গ্রাফের মডেলটির কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর তিনি যেটা করলেন বিজ্ঞানের সত্যিকারের শিক্ষকরা সেটা করে না, ভ্যান ডি গ্রাফের উপরের বড় গোলাকার অংশটি একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইলেন। উপস্থিত ছেলেমেয়েরা চমৎকৃত হয়ে দেখল ভ্যান ডি গ্রাফের গোলক থেকে বিশাল একটা বিদ্যুৎ ঝলক প্রায় বজ্রপাতের মতো ফারুখ বখতের দিকে ছুটে গেল এবং ফারুখ বখত বিকট চিৎকার করে ঘরের এক কোণায় ছিটকে পড়লেন। দেয়ালে তাঁর মাথা ঠুকে গেল, প্রথম তার চোখের সামনে নানা রঙের আলো খেলা করতে লাগল এবং শেষে হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
যখন তার জ্ঞান হল তখন তিনি মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর মুখের উপর উবু হয়ে আছেন স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিও এবং তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের সব কয়জন ছেলেমেয়ে, তাদের চোখেমুখে ঝলমল করছে হাসি। তাঁকে চোখ খুলতে দেখে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট মেয়ে বলল, “কী সুন্দর স্থির বিদ্যুৎ–এরকম আর দেখি নাই।”
কাছাকাছি আরেকজন বলল, “আরেকবার দেখাবেন স্যার?” মার্থা রোজারিও বললেন, “যাও ছেলেমেয়েরা সরে যাও। পিছনে যাও।”
ছেলেমেয়েরা একটু জায়গা করে দিল এবং তখন ফারুখ বখত কোনোরকমে উঠে বসলেন। কাছাকাছি কোথায় চুনু মিয়া দাঁড়িয়ে ছিল, এগিয়ে এসে বলল, “ভালো আছেন স্যার?”
ফারুখ বখত দেয়াল ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে চুনু মিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। চুনু মিয়া একটু ঘাবড়ে গিয়ে দুর্বল গলায় বলল, “মার্থা আপাকে বলেছিলাম পোড়ানীতি পড়ার কথা–”
ফারুখ বখত মেঘস্বরে বললেন, “পোড়ানীতি না, পৌরনীতি–”
”ঐ একই কথা স্যার। মার্থা আপা রাজি হলেন না।”
মার্থা রোজারিও কাছেই ছিলেন, নরম গলায় বললেন, “সেই কবে পড়েছি, এখন তো আর মনে-টনে নেই। ইংরেজি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।”
ফারুখ বখত একটু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে পৌরনীতি আজ পড়া হবে না।”
মার্থা রোজারিও বললেন, “পৌরনীতির শিক্ষকটা কে ছিল?”
“আমি।”
“তাহলে আপনি কেন পড়াচ্ছেন না?”
“কারণ আমি বিজ্ঞান পড়াচ্ছি।”
“বিজ্ঞানের শিক্ষক?”
“রাণুদিদি। বাংলা পড়াচ্ছেন।”
“বাংলার শিক্ষক?”
”মির্জা মাস্টার। ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা করাচ্ছেন।”
এই সময়ে চুনু মিয়া মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার। মির্জা স্যার মাটিতে শুয়ে আছেন। সব ছেলেমেয়েরা তাকে টেনে টেনে নিচ্ছে–”
মার্থা রোজারিও বাধা দিয়ে বললেন, “মির্জা মাস্টার কেন খেলাধুলা করাচ্ছেন? খেলাধুলার জন্যে রয়েছে রুখসানা!”
ফারুখ বখত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “রুখসানা আজকে অঙ্ক পড়াচ্ছে।”
“কেন? অঙ্কের শিক্ষক কোথায়?”
“অঙ্কের শিক্ষক প্রফেসর আলি ছাত্রদের কম্পিউটার শেখাচ্ছেন।”
“আর কম্পিউটারের শিক্ষক?”
“মহসিন। মহসিন আজকে ইংরেজি পড়াচ্ছে।”
“কেন?”
“ইংরেজি পড়ায় ফরাসত আলি, আজকে সে আসেনি, সেই জন্যেই তো এই গোলমাল।“
চুনু মিয়া একটু কেশে বলল, “স্যার একটা কথা–”
ফারুখ বখত একটা ছোট ধমক দিয়ে বললেন–”চুনু মিয়া তুমি একটু বেশি কথা বল। কাজের কথা বলছি তার মাঝে বিরক্ত করছ?”
“শুধু একটা ছোট কথা–খুবই ছোট।”
“কী কথা? তাড়াতাড়ি বলো।”
“মার্থা আপা বলেছেন তিনি ইংরেজি পড়াতে পারেন। যদি মার্থা আপাকে ইংরেজি পড়াতে দেন, তা হলে মহসিন স্যার–”
ফারুখ বখত চমকে উঠে বললেন, “চুনু মিয়া, তুমি শেষ পর্যন্ত একটা খাঁটি কথা বলেছ। মার্থা রোজারিও পড়াবেন ইংরেজি, তা হলে মহসিন শেখাবে কম্পিউটার, প্রফেসর আলি শেখাবেন অঙ্ক, খেলাধুলায় যাবে রুখসানা, মির্জা মাস্টার ফিরে আসবে বাংলায়–”
মার্থা রোজারিও বললেন, “সব সমস্যার সমাধান!”
চুনু মিয়া একগাল হেসে বলল, “আসলে স্যার আজকের দিনটাতেই কুফা লেগেছে, এইজন্যে এত গোলমাল।”
“কুফা কেন লাগবে?”
“কোনো কোনো দিন এরকম হয়। সকালে একজন মানুষ এসেছিল মাথা কামানো তার পরেই মনে হল গোলমাল–”
ফারুখ বখত হঠাৎ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাথা কামানো?”
“জি স্যার। চুল-দাড়ি সবকিছু কামানো–“
“কী করছিল সেই মানুষ?”
“ঘুরঘুর করছিল স্কুলে।”
“কোথায় সেই মানুষ?”
“বের করে দিয়েছি স্যার। আমার সাথে চোটপাট করেছিল তখন পুলিশে হাওলা করে দিয়েছি। থানায় ধরে নিশ্চয়ই শক্ত মার দিয়েছে এখন!” চুনু মিয়া দাঁত বের করে হাসল।
ফারুখ বখত ঘুরে চুনুমিয়ার দিকে তাকালেন, মেঘস্বরে বললেন, “মানুষটা কি ফরাসত আলি ছিল?”
“ফরাসত স্যার? চুনু মিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “ফরাসত স্যার হবে কেমন করে? স্যারের এত বড় চুল-দাড়ি–”
“তুমি জান না ফরাসত আলি গরমের সময় চুল-দাড়ি সব কেটে ফেলে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যায়। জান না?”
চুনু মিয়ার মুখ প্রথমে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কিছুক্ষণেই সেখানে নীল এবং গোলাপি রঙের ছোপ দেখা গেল। তারপর হঠাৎ সে দড়াম করে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেল।