“আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু একটু পরে আমার বিজ্ঞান ক্লাস। আমি এই ভ্যান ডি গ্রাফ জেনারেটরটা দাঁড় করাচ্ছি, স্থির বিদ্যুতের উপর একটা লেকচার দেব।”
“সেটা যখন সময় হবে কিছু-একটা ব্যবস্থা হবে। এখন আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”
রাণুদিদি ইতস্তত করে বললেন, “আমি পুরোটা প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছি, এই সুইচটা টিপে একটু দেখতাম–”
“সময় নেই রাণুদিদি, ফারুখ বখত মাথা নাড়লেন।
”ঠিক আছে, তা হলে চলেন যাই।
একটু পরে দেখা গেল রাণুদিদি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চোখে চশমাটা ঠিক করে বসিয়ে বললেন, “খোকাখুকুরা আজকে আমি তোমাদের বাংলা পড়াব।”
“বাংলা?”
“হ্যাঁ, বাংলা। বাংলা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দিকপালের নাম কী বলল দেখি?”
বাচ্চারা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
“ভেরি গুড। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল আরও একজন মানুষের, তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। তোমরা আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছ?”
ছেলেমেয়েরা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। রাণুদিদি উৎসাহ নিয়ে বললেন, “আইনস্টাইন ছিলেন মস্ত বড় বিজ্ঞানী। তাঁর একটা খুব বড় আবিষ্কারের নাম স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। সেই জিনিসটা কী কে বলতে পারবে?”
বাচ্চারা কোনো কথা না বলে চোখ বড় বড় করে রাণুদিদির দিকে তাকিয়ে রইল। রাণুদিদি হাসিমুখে বললেন, “স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি খুব মজার জিনিস। মনে করো তোমরা একটা রকেটে উঠেছ, রকেটের গতিবেগ আলোর গতিবেগের কাছাকাছি। সেই রকেটটা–”
রাণুদিদি বাংলা ক্লাস পড়াতে লাগলেন খুব উৎসাহ নিয়ে।
এদিকে ফারুখ বখত নিজের মাথার চুল প্রায় ছিঁড়ে ফেলছেন। এক্ষুনি বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু সেই ক্লাসে পড়ানোর জন্যে রাণুদিদি নেই–তাঁকে বাংলা ক্লাসে পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হবার পরপরই পৌরনীতির ক্লাস, যেটা তাঁর নিজের নেয়ার কথা। ফারুখ বখত কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি নিজে বিজ্ঞান ক্লাসটা নিতে পারেন কিন্তু অন্য কাউকে পৌরনীতি ক্লাসটা নিতে হবে। অন্য কেউ বলতে বাকি রয়েছে মাত্র দুইজন। স্কুলের বাবুর্চি তথা দারোয়ান তথা দপ্তরি চুনু মিয়া এবং স্কুলের নার্স মার্থা রোজারিও। চুনু মিয়া খুব চৌকস মানুষ, সে যদি একটা ক্লাস পড়িয়ে ফেলতে পারে অবাক হবার কিছু নেই। তিনি একবার চেষ্টা করে দেখার চেষ্টা করলেন। জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে ডাকলেন, চুনু মিয়া
চুনু মিয়া প্রায় সাথে সাথে ছুটে এল। ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “তুমি তো অনেক কাজের মানুষ।
চুনু মিয়া একগাল হেসে বলল, “আপনাদের দোয়া।”
“বাচ্চাদের একটা বিজ্ঞানের ক্লাস নিতে পারবে? বেশি কঠিন কিছু না, একটু আর্কিমিডিসের সূত্র–একটু নিউটনের সূত্র–”
চুনু মিয়া হাতজোড় করে বলল, মাপ করেন স্যার, “আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশোনা করি নাই।”
“পড়াশোনা কর নাই?”
“না স্যার।”
ফারুখ বখত চোখ পাকিয়ে চুনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চুনু মিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “মার্থা আপা অনেক শিক্ষিত মানুষ। মার্থা আপাকে নিয়ে আসি?”
ফারুখ বখত খানিকক্ষণ কী-একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি বিজ্ঞান ক্লাসটা নিতে। তুমি মার্থা আপাকে গিয়ে ডেকে আনো, বলো তাকে পৌরনীতি ক্লাসটা নিতে হবে।”
“পৌড়ানীতি?”
“পৌড়ানীতি না, পৌরনীতি।”
“ঐ একই কথা।” চুনু মিয়া এক গাল হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ফারুখ বখত হাত দিয়ে মাথার চুলগুলি ঠিক করে রওনা দিলেন। বিজ্ঞান ক্লাসে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছিল। ফারুখ বখতকে ঢুকতে দেখে সবাই চুপ করে গেল, ঢ্যাঙ্গামতন একজন জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি?”
“হ্যাঁ। আমি। আমি আজকে তোমাদের বিজ্ঞান পড়াব।”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
“আপনি পারবেন?”
ফারুখ বখত ভুরু কুঁচকে বললেন, “পারব না কেন?”
“কী পড়াবেন স্যার আজকে?”
“আজকে আমি তোমাদের পড়াব বিদ্যুৎ। স্থির বিদ্যুৎ।” ফারুখ বখত সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করলেন। ছাত্রছাত্রী কেউ না হেসে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে রইল। ফারুখ বখত একটু কেশে বললেন, “বিদ্যুৎ কী তোমরা সবাই জান। বিদ্যুৎ মানে হচ্ছে ইলেকট্রিসিটি। ইলেকট্রিসিটি মানে হচ্ছে বিদ্যুৎ”এইটুকু বলে ফারুখ বখত বুঝতে পারেন তিনি বিদ্যুৎ সম্পর্কে আর কিছুই জানেন না। হঠাৎ করে তিনি কেমন জানি বিপন্ন রোধ করতে থাকেন। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল; তিনি কয়েকবার ঢোক গিললেন।
সামনে বসে থাকা সাদাসিধে চেহারার একটা মেয়ে বলল, “স্যার স্থির বিদ্যুৎ মানে কী?”
“স্থির বিদ্যুৎ মানে হচ্ছে যে বিদ্যুৎ স্থির। মানে যেটা নড়াচড়া করে না।”
“বিদ্যুৎ আবার নড়াচড়া করে কেমন করে?”
ফারুখ বখত চোখে অন্ধকার দেখলেন, একটু কেশে বললেন, “তোমাদের এখন স্থির বিদ্যুৎ দেখাব।”
“স্যার স্থির বিদ্যুৎ দেখা যায়?”
“এ্যাঁ–ইয়ে মানে মনে হয় দেখা যায়। তিনি তখন টেবিলের উপর রাখা ভ্যান ডি গ্রাফ যন্ত্রের কাছে গিয়ে বললেন, “এটার নাম ভ্যান-ভ্যান ভ্যান”
হঠাৎ করে তিনি নামটা ভুলে গেলেন, আর সব ছেলেমেয়ে খুশিতে হেসে ফেলল।”কী সুন্দর নাম, ভ্যান ভ্যান ভ্যান।”
ফারুখ বখত বুঝতে পারলেন যতই সময় যাচ্ছে ততই তিনি গোলমাল করে ফেলছেন। জোর করে আবার একটু হেসে বললেন, “এখন তোমাদের দেখাব স্থির বিদ্যুৎ।”