ফরাসত আলি প্রথম কয়েকদিন তাঁর লটারির টিকেট বিক্রি করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেগুলি ইলিশ মাছের মতো বিক্রি হল না। রইসউদ্দিন নামে তাঁর একজন প্রফেসর-বন্ধু আছে, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভুল করে আমি একশোটা লটারির টিকেট কিনে ফেলেছি। তুমি কি কয়টা কিনতে চাও?
তাঁর প্রফেসর-বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “নাম্বার কত?”
“নাম্বার?”
“হ্যাঁ।”
“কিসের নাম্বার?”
“লটারির টিকেটে সবসময় নাম্বার থাকে জান না?”
ফরাসত আলি তখন টিকেটগুলি বের করে নাম্বার দেখলেন। প্রথমটার নাম্বার চ-১১১১১১১১। তার বন্ধু রইসউদ্দিন নাম্বারটা দেখে গম্ভীর হয়ে বললেন, “জাল টিকেট।”
“জাল?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কখনো লটারির টিকেটের নাম্বার এরকম হয় না। চ-এর পরে আটটা এক এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি অঙ্কের প্রফেসর, আমি এসব জানি। পোভাবিলিটি বলে একটা কথা আছে তার নিয়ম অনুযায়ী এটা অসম্ভব।”
ফরাসত আলি সেটা নিয়ে বেশি তর্ক করলেন না। তিনি অঙ্ক ভালো বোঝেন না। পরদিন তাঁর দেখা হল এমাজউদ্দিনের সাথে, এমাজউদ্দিন তার বেশ
অনেকদিনের বন্ধু, কাস্টমসে চাকরি করে। ফরাসত আলি বললেন, “আমার কাছে কিছু লটারির টিকেট আছে, ভুল করে কিছু কিনে ফেলেছি। তুমি কি কয়েকটা কিনতে চাও?”
“কত টাকার লটারি?”
ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “মনে হয় তিরিশ লাখ টাকার।”
এমাজউদ্দিন তার বিদেশি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, “মাত্র তিরিশ লাখ? বেশি টাকা না হলে আমি লটারি খেলি না।”
ফরাসত আলি ভয়ে ভয়ে বললেন, “তিরিশ লাখ টাকা বেশি হল না?”
ধুর! তিরিশ লাখ একটা টাকা হল নাকি? এক দুই লাখ টাকা তো আমার হাতের ময়লা।”
ফরাসত আলির কাস্টমসের বন্ধু এমাজউদ্দিন একটু পরে বললেন, “আর তুমি কেমন করে জান এটা তিরিশ লাখ টাকার লটারি? হয়তো আরও কম।”
ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “কম হওয়ার তো কথা না। একটা টিকেটের নাম্বার চ, তার পরে আটটা এক। এত বড় যদি নাম্বার হয় তার মানে অনেক বড় লটারি–”
এমাজউদ্দিন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “এগুলি লোক-ঠকানোর বুদ্ধি-মনে হয় সস্তা লটারি। হাজার দুই হাজার টাকার! হা হা হা–”
ফরাসত আলি তবু হাল ছাড়লেন না। তাঁর একজন ডাক্তার-বন্ধু আছেন, তাঁকেও একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “আমার কাছে কিছু বাড়তি লটারির টিকেট আছে, তুমি কি কিনতে চাও?”
তাঁর ডাক্তার-বন্ধুর নাম তালেব আলি, তিনি হেহে করে হেসে বললেন, “রইসউদ্দিন আমাকে বলেছে, তুমি নাকি অনেকগুলি জাল টিকেট নিয়ে ফেঁসে গেছ! টিকিটের নাম্বার নাকি চ, তার পরে আটটা এক! রইসউদ্দিন অঙ্কের প্রফেসর–আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জাল টিকেটে সবসময় এরকম নাম্বার হয়। সত্যিকার টিকেটে নাম্বারগুলি হয় সব সংখ্যা দিয়ে!”
ফরাসত আলি শেষ চেষ্টা করলেন তাঁর অ্যাডভোকেট-বন্ধু আব্বুল করিমের কাছে। আব্বুল করিম মাথা নেড়ে বললেন, “আমার সাথে এমাজউদ্দিনের দেখা হয়েছিল। এমাজউদ্দিন বলেছে এটা নাকি কম পয়সার লটারি, এই টিকেট কেনা মানে মাছি মেরে হাত কালো করা।”
ফরাসত আলি তখন হাল ছেড়ে দিলেন। একবার ভাবলেন রেগেমেগে টিকেটগুলি নর্দমায় ফেলে দেবেন, কিন্তু কী ভেবে শেষ পর্যন্ত ফেললেন না, তোশকের নিচে রেখে দিলেন। সেদিন রাতে তাঁর বন্ধু ফারুখ বখতের সাথে দেখা হল। ফারুখ বখত তার ছেলেবেলার বন্ধু, ভবিষ্যতে কী করবেন সেটা নিয়ে সবসময় চিন্তাভাবনা করেন বলে এমনিতে বিশেষ কাজকর্ম করার সময় পান না। তিনি অসম্ভব শুকনো, মাথার চুলগুলি ঝোড়োকাকের মতে, মুখে বেমানান অনেক বড় বড় গোঁফ। এমনিতে তাকে দেখলে মনে হয় বুঝি অনেক রাগী কিন্তু ফারুখ বখত খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু বলে একজন আরেকজনকে তুই তুই করে বলেন। ফরাসত আলিকে দেখে তিনি একগাল হেসে বললেন, “ফরাসত, তুই নাকি অনেকগুলি লটারির টিকে কিনে ফেঁসে গেছিস?”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“সবাই জানে! রইসউদ্দিন বলেছে। এমাজউদ্দিন বলেছে। একটা টিকেটের নাম্বার নাকি চ ১১১১১১১১?”
ফরাসত আলী মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ!”
“একশোটা টিকেট তুই কেন কিনলি?”
ফরাসত আলি তখন তাঁকে সবকিছু খুলে বললেন-কেমন করে তাঁকে লটারির টিকেট কিনতে হল তার পুরো বৃত্তান্ত। সব শুনে ফারুখ বখত বললেন, “মন খারাপ করিস না। ধরে নে টাকাটা দান করেছিস। লটারির টাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হবে, অনেক বড় সৎকাজ।”
“তবুও এতগুলি টাকা খামোখা”
“ঠিক আছে পঞ্চাশটা আমাকে দিস।”
“পঞ্চাশটা?”
“হ্যাঁ। বাকিতে। এখন পকেটে টাকা নেই, যখন হবে দিয়ে দেব।”
.
পরের শনিবার ব্যাপারটা ঘটল। অঙ্কের প্রফেসর রইসউদ্দিন সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখলেন লটারির ফল বের হয়েছে। প্রথম পুরস্কার তিরিশ লাখ টাকা যে-টিকেটটা লটারী পেয়েছে তার নাম্বার চ ১১১১১১১১! চ-য়ের পর আটটা এক। অঙ্কের প্রফেসর দুইবার গুনে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
তার স্ত্রী চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে গো? রাডপ্রেশারটা আবার বেড়েছে?”
রইসউদ্দিন বুক চাপড়ে বললেন, “না গো ব্লাডপ্রেশার না! ত্রিশ লাখ টাকা এই হাতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেছে। ত্রিশ লাখ টাকা!”