কালোমতন একজন বলল, “স্যার, বাঁশের উপরে উঠে কেন কম্পিউটার চালু করব? টেবিলের উপরেই ভাল–”
প্রফেসর আলিকে কম্পিউটারের ক্লাসে পাঠিয়ে ফারুখ বখত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন। এক্ষুনি অন্য একটা ক্লাসে প্রফেসর আলির অঙ্ক শেখানোর কথা ছিল, এখন কোনো অঙ্কের শিক্ষক নেই। তিনি মাথায় হাত দিচ্ছিলেন ঠিক তখন দেখতে পেলেন তাদের খেলাধুলার শিক্ষক রুখসানা গলায় একটা হুইসেল ঝুলিয়ে যাচ্ছে, ফারুখ বখত চিৎকার করে বললেন, “রুখসানা! রুখসানা!!”
রুখসানা ছুটে এল, “কী হয়েছে?”
“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
“কী ঝামেলা?”
“ক্লাস থ্রি সেকশান বি-এর এক্ষুনি অঙ্ক ক্লাস শুরু হবে, ক্লাস নেয়ার কেউ নেই। তুমি কি নিতে পারবে ক্লাসটা?”
“আমি? কিন্তু একটু পরেই আমার একটা ক্লাসের পি.টি. ট্রেনিং।”
“সেটা তখন দেখা যাবে। এখন তুমি ছুটে যাও এই ক্লাসে। দেরি কোরো।”
রুখসানা চিন্তিত মুখে অঙ্ক ক্লাসে ঢুকতেই ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, রুখসানাকে সবার খুব পছন্দ। নানারকম খেলাধুলা দৌড়ঝাঁপ সবকিছুতে রুখসানার খুব উৎসাহ, বাচ্চারা তাকে পছন্দ করবে বিচিত্র কী?
সবাই সমস্বরে বলল, “খেলা খেলা খেলা!” রুখসানা বলল, “না এখন খেলা না। এখন অঙ্ক।”
“অঙ্ক?” বলা বাহুল্য সব বাচ্চার মন-খারাপ হয়ে যায়।
“হ্যাঁ অঙ্ক। এই যে আমি ব্ল্যাকবোর্ডে তোমাদের দুইটি সংখ্যা লিখে দিচ্ছি। দুইটি সংখ্যাকে কখনো করবে যোগ কখনো বিয়োগ কখনো গুণ কখনো ভাগ।”
”কেমন করে বুঝব আমরা?”
“খুব সহজ।” রুখসানা হাসিমুখে বলল, “আমি যখন শূন্যে ডিগবাজি দেব তার মানে যোগ। যদি হাত দিয়ে পায়ের পাতা ছুঁই তার মানে বিয়োগ। যদি বুকডন দিই সেটা হবে গুণ আর যখন দুই হাত পাশে ছড়িয়ে লাফ দেব তার মানে ভাগ। তোমরাও করবে আমার সাথে। আর অঙ্কের উত্তরটি কাগজে লেখার দরকার নেই–
“তা হলে কেমন করে করব?”
“খুব সোজা! অঙ্কের উত্তরটি দেবে তোমরা লাফিয়ে। যদি উত্তর হয় দশ তা হলে দশবার লাফাবে। যদি হয় বারো তা হলে বারো বার লাফাবে–”
একটু পরেই শোনা গেল অঙ্ক ক্লাসে হুইসিল বাজছে এবং ছেলেমেয়েরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দৌড়ে ঝাপাঝাপি করে অঙ্ক করছে।
রুখসানাকে অঙ্ক ক্লাসে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এক্ষুনি একটা খেলাধুলার ক্লাস শুরু হবে, সেখানে কাকে পাঠানো যায় ফারুখ বখত ঠিক চিন্তা করে পেলেন না। আশেপাশে কেউ নেই, তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দেখলেন মির্জা মাস্টার তার বিশাল শরীর নিয়ে থপথপ করে হেঁটে আসছেন। ফারুখ বখত তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে গলা বের করে বললেন, “মির্জা মাস্টার!”
“কী হল?”
“ভিতরে ঢুকবেন না। বাইরে মাঠে থাকেন!”
“কেন?”
“আপনাকে একটা খেলাধুলার ক্লাস নিতে হবে।”
“আমার? কী বলছেন আপনি? একটু পরে আমার একটা বাংলা ক্লাস নেয়ার কথা।”
ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “তার কিছু-একটা ব্যবস্থা করা যাবে, এখন আপনি খেলাধুলার এই ক্লাসটা নেন। কোনো উপায় নেই।”
মির্জা মাস্টার আরও একটা-কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই ছাত্রছাত্রীরা হৈচৈ করতে করতে মাঠে এসে হাজির হয়েছে!
মির্জা মাস্টার চি চি করে বললেন, “ছাত্রছাত্রীরা, আমি এখন তোমাদের খেলাধুলা করাব।”
সব ছাত্রছাত্রী নিঃশ্বাস বন্ধ করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বড় বড় চোখের ফুটফুটে একটা মেয়ে বলল, “আপনি?”
|”হ্যাঁ। প্রথমে শরীরটা একটু গরম করে নেয়া দরকার। শরীর গরম না করে খেলাধুলা শুরু করা ঠিক নয়।”
সব ছেলেমেয়ে মাথা নাড়াল, “না, ঠিক না।”
“কাজেই শরীর গরম করার জন্যে আমরা সবাই এখন স্কুলের মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে যাব।”
“আ-আ-আপনিও?”
“আমিও।”
দিকে তাকিয়ে রইল।লন। তাঁর পিছুপিছু মাটিতে লম্বা হয়ে
উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে হঠাৎ আশ্চর্য এক ধরনের নীরবতা নেমে এল। মির্জা মাস্টার যতদূর সম্ভব গলা উঁচিয়ে বললেন, রেডি ওয়ান টু থ্রি–”
ছাত্ররা তবু কেউ দৌড়ানো শুরু করল না, বিস্ফারিত চোখে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। মির্জা মাস্টার তখন নিজেই থপথপ করে তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। তাঁর পিছুপিছু ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা।
খানিকক্ষণ পর দেখা গেল মির্জা মাস্টার মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তার হাত-পা ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ফারুখ বখত বারবার নিজের ঘড়ি দেখছিলেন। এতক্ষণে ফরাসত আলির পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তার কোনো দেখা নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই মির্জা মাস্টারের একটা বাংলা ক্লাস নেবার কথা, কিন্তু তাঁকে পাঠিয়েছেন খেলাধুলার ক্লাস নেয়ার জন্যে, কাউকে এখনই দরকার। হঠাৎ তার রাণুদিদির কথা মনে পড়ল, বাংলা পড়াতে রাণুদিদির কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।
রাণুদিদির বিজ্ঞান ক্লাস উপরের তলায়। মই বেয়ে উপরে উঠে গেলেন ফারুখ বখত। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে একটা ছোট যন্ত্র দাঁড় করাচ্ছিলেন রাণুদিদি। ফারুখ বখতকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার ফারুখ সাহেব?”
“মহাসমস্যা রাণুদিদি।”
“কী সমস্যা?”
“এক্ষুনি ক্লাস টু সেকশান এর বাংলা ক্লাস শুরু হবে।”
“সেটা সমস্যা?”
“না। সেটা সমস্যা নয়। কিন্তু কোনো শিক্ষক নেই, সেটা হচ্ছে সমস্যা। আপনাকে ক্লাসটা নিতে হবে।”