ফরাসত আলি বুঝতে পারলেন দাড়ি-গোঁফ-চুল সব কামিয়ে ফেলেছেন বলে মহসিন তাকে চিনতে পারছে না। একগাল হেসে বললে, “আমি ফরা–”
“পড়া?” মহসিন মাঝপথে থামিয়ে বলল, “আপনি পড়াশোনা করতে এসেছেন? দেখছেন না এটা বাচ্চাদের স্কুল! শুধু বাচ্চারা পড়াশোনা করছে। আপনি পড়তে চাইলে কলেজে যাবেন, ইউনিভার্সিটি যাবেন।”
ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “না, না আমি ফরাসত–”
“ফরাসত আলি সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইলে এখানে এসেছেন কেন? এটা কম্পিউটার-ঘর। এখানে বাচ্চাকাচ্চারা কম্পিউটার ব্যবহার শিখে–”
“না না, আমি ফরাসত আলির সাথে দেখা করতে চাই না। আমি–”
“তা হলে আপনি এখানে কী করছেন? নিচে যান। স্কুল চলার সময় বাইরে থেকে লোকজন এলে স্কুলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। যদি স্কুলটা দেখতেই চান অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে আসবেন।”
ফরাসত আলি আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন মহসিন শুনল না, তাঁকে ঠেলে বের করে দিয়ে উপর থেকে চিৎকার করে চুনু মিয়াকে ডেকে বলল, “চুমু মিয়া, এই লোকটিকে এখান থেকে নিয়ে যাও। কম্পিউটার ঘরে ঘুরঘুর করছে।”
মহসিনের কথা শেষ হবার আগেই চুনু মিয়া দুই লাফে উপরে উঠে ফরাসত আলির হাত ধরে হিড়হিড় করে নিচে নামিয়ে নিল। বলল, “স্কুল চলার সময় এখানে বাইরের মানুষের কারফিউ। কেন এসেছেন আপনি?”
ফরাসত আলি আস্তে আস্তে রেগে উঠছিলেন, গলা উঁচিয়ে বললেন, “চুন্ন মিয়া–”
চুনু মিয়া তখন আরও রেগে গেল, চিৎকার করে বলল, “এত বড় সাহস আমার সাথে গলাবাজি। আমাকে চেনেন না আপনি? ফরাসত স্যার নিজে আমাকে বলেছেন স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝে যেন একটা মাছি ঢুকতে না পারে, আর আপনি এত বড় একটা মানুষ ঢুকে গেছেন? কত বড় সাহস
ফরাসত আলি তখন আরেকটু রেগে গেলেন, বললেন, “মুখ সামলে কথা বলো চুনু মিয়া–”
“কেন? আপনাকে ভয় পাই নাকি আমি? কম্পিউটার ঘরে ঘুরঘুর করছেন, লাখ লাখ টাকার কম্পিউটার সেখানে, আপনার মতলব আমরা বুঝি না মনে করছেন? আপনাকে পুলিশে দেয়া দরকার–“
“পুলিশে? তোমার এত বড় সাহস! তুমি আমাকে পুলিশে দেবে?”
চুনু মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস হল না? ঠিক আছে এই দেখেন—”
কিছু বোঝার আগে ফরাসত আলি আবিষ্কার করলেন চুনু মিয়া তাঁকে দুজন পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে এবং তারা কম্পিউটার-ঘরে সন্দেহজনক কার্যকলাপের জন্যে তাকে ধরে হাজতে পুরে ফেলেছে। ফরাসত আলি কয়েকবার পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনো লাভ হল না। বলা যেতে পারে হঠাৎ করে ফরাসত আলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
এদিকে স্কুলে ফারুখ বখত বারবার পায়চারি করছেন। সকালবেলা ফরাসত আলি একটা ইংরেজি ক্লাস নেন, তাঁর এখনও কোনো দেখা নেই। ক্লাসে শিক্ষক আসছে না ছাত্রদের জন্যে সেটা খুব খারাপ উদাহরণ–ফারুখ বখত অনেক ভেবেচিন্তে মহসিনকে ডেকে পাঠালেন। মহসিন তার কম্পিউটার-ঘরে তালা মেরে ফারুখ বখতের কাছে হাজির হল। ফারুখ বখত মহসিনকে বললেন, “মহসিন ফরাসত আলি আসেনি, আজকে তোমাকে ইংরেজি ক্লাসটা নিতে হবে।
মহসিন মাথা চুলকে বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। কোনো উপায় নেই, তাড়াতাড়ি যাও।”
“কিন্তু আমি কখনো ইংরেজি ক্লাস নিইনি।”
“তাতে কী আছে? তাড়াতাড়ি যাও।”
মহসিন চিন্তিত মুখে ক্লাসে হাজির হল। ছাত্রছাত্রীরা তাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “কম্পিউটার স্যার, কম্পিউটার স্যার!!”
মহসিন মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু এখন আমি তোমাদের ইংরেজি পড়াব।” ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “ইংরেজি ইংরেজি!!”
মহসিন বলল, “এখন বলো দেখি মাইক্রোপ্রসেসর কেমন করে বানান করে? হার্ড ড্রাইভ? র্যান্ডম এক্সেস মেমোরি?”
ছাত্রছাত্রীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। মহসিন হাসিমুখে বলল, “খুব সোজা, একেবারে পানির মতো সোজা। এম-আই-সি …”
একদিন ফারুখ বখত আবিষ্কার করলেন মহসিনকে ইংরেজি পড়াতে পাঠানো ঠিক হয়নি, এক্ষুনি অন্য একটা ক্লাসে কম্পিউটার শেখানোর কথা। তারা দল বেঁধে হাজির হয়ে গেছে, কী করবেন বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি অঙ্কের শিক্ষক প্রফেসর আলিকে ডেকে পাঠালেন। প্রফেসর আলি তার বইপত্র নিয়ে হাজির হলেন, ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
“কী সমস্যা?”
“কম্পিউটারের ক্লাস, কিন্তু মহসিনকে পাঠিয়েছি ইংরেজি ক্লাস নেয়ার জন্যে। এখন কম্পিউটারের ক্লাস নেবার কেউ নেই।”
প্রফেসর আলি তর্ক করতে ভালোবাসেন, মুখ ছুঁচালো করে বললেন, “কেন পাঠালে মহসিনকে?”
“আর কেউ ছিল না আশেপাশে। এখন আপনাকে একটু কম্পিউটারের ক্লাসটা নিতে হবে।” ফারুখ বখত মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, “খোদার কসম!”
“খোদা বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই!” ঘোর নাস্তিক প্রফেসর আলি মুখ শক্ত করে বললেন, “যার অস্তিত্ব নেই তার কসমে আমি বিশ্বাস করি না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, পাউরুটির কসম।”
প্রফেসর আলি চোখ কপালে তুলে বললেন, “পাউরুটির কসম?”
“হ্যাঁ, পাউরুটির অস্তিত্ব নিয়ে তো আপনার মনে কোনো দ্বিধা নেই। পাউরুটির কসম আপনি এই ক্লাসটা নেন।”
প্রফেসর আলি আরও কিছুক্ষণ তর্ক করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কম্পিউটার-ঘরে হাজির হলেন। একটু পরে শোনা গেল তিনি বলছেন, “মনে করো এই ঘরে একটা দুই মিটার উঁচু তৈলাক্ত বাঁশ রয়েছে, আর তোমরা কম্পিউটারটা হাতে নিয়ে এই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠছ। প্রতি সেকেণ্ডে তোমরা দশ সেন্টিমিটার উপরে ওঠ, কিন্তু পরের সেকেন্ডে পাঁচ সেন্টিমিটার পিছলে নেমে আস। বাঁশের উপরে উঠে যদি কম্পিউটারটা চালু করতে চাও কতক্ষণ সময় লাগবে?”