স্কুলের জন্যে একজন ডাক্তার খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হল। যে-ডাক্তারের কাছেই যান সে-ই বলে, আপনাদের উদ্দেশ্য খুব মহৎ, কিন্তু এর জন্যে তো ডাক্তারের দরকার নেই। সব সুস্থ-সবল ছেলে। ডাক্তারের তো কোনো কাজ থাকবে না, বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে যাবে!
ফরাসত আলি বললেন, “কিন্তু যদি অসুখ করে?”
“তখন যাবে ডাক্তারের কাছে।”
“যদি চেকআপ করাতে হয়?”
“তখন আসবে একজন ডাক্তার।”যদি হঠাৎ করে কানো অ্যাকসিডেন্ট হয়?”
ডাক্তারেরা মাথা চুলকে বলেন, “এমনভাবে স্কুলঘরটা তৈরি করবেন যেন কোনো অ্যাকসিডেন্ট না হয়। যদি তবু কিছু ঘটে যায় ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবেন।”
ফারুখ বখত মনমরা হয়ে বললেন, “ভাবছিলাম স্কুলে সব সময় ডাক্তার থাকবে–”
ডাক্তারেরা মাথা নেড়ে বলেন, “কিছু দরকার নেই। একজন নার্স থাকলেই যথেষ্ট। বিলাত আমেরিকার স্কুলেও ডাক্তার থাকে না, শুধু একজন নার্স থাকে।”
শেষ পর্যন্ত তা-ই ঠিক হল, স্কুলে শুধু একজন নার্স থাকবে। খুঁজে-পেতে একজন নার্স পাওয়া গেল, ভদ্রমহিলা স্থানীয় খ্রিস্টান, নাম মার্থা রোজারিও। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, হাসিখুশি মহিলা, বাংলায় একটু উত্তরবঙ্গের টান রয়েছে। মাঝে মাঝে আমার’ বলতে গিয়ে হামার’ বলে ফেলেন। দীর্ঘদিন নানা হাসপাতালে কাজ করেছেন, প্রচুর অভিজ্ঞতা, সত্যিকারের ডাক্তার না থাকলেও কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। তা ছাড়া রাগী-রাগী চেহারার একজন ডাক্তার থেকে হাসিখুশি একজন মহিলা ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্যে ভালো।
স্কুলের কর্মচারীদের মাঝে যাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া গেল সে হচ্ছে বাচ্চাদের খাবার রান্না করার জন্য একজন বাবুর্চি। তার নাম চুনু মিয়া। সে স্কুল তৈরি করার সময় হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ডান হাত ছিল। খুব কাছের মানুষ, এমন কোনো কাজ নেই যেটা করতে পারে না। স্কুলের নানারকম কাজকর্মে সে আগে থেকেই লেগেছিল, বাবুর্চির দরকার শুনে নিজেকে দাখিল করে দিল। তার বাবা এবং দাদা নাকি মুন্সিগঞ্জ এলাকার বিখ্যাত বাবুর্চি। সে নিজেও বিয়ে জন্মদিন বা বউভাত উপলক্ষে রান্না করতে যায়। শহরের কোনো কোনো অঞ্চলে তাকে লোকজন ওস্তাদ চুনু মিয়া বলে ডাকে।
ফারুখ বখত চুনু মিয়ার আবেদন শুনে বললেল, “এটা কিন্তু বাচ্চাদের স্কুল। এদের জন্যে কিন্তু কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে হবে না।”
চুনু মিয়া বলল, “কোনো অসুবিধা নাই। আমি ঢাকা শহরে সাহেবমেমদের বাসাতে কাজ করেছি, চপ-কাটলেটও তৈরি করতে পারি।”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “উঁহু। সাহেবি খাওয়া চলবে না।”
“কোনো সমস্যা নাই। দেশি খাবার রাঁধতে পারি। শিঙাড়া সমুচা নিমকি–”
ফারুখ বখত বাধা দিয়ে বললেন, “না না, শিঙাড়া সমুচা ভাজাভুজি চলবে না। আটার রুটি আর শবজি। সাথে ফলমূল আর কাঁচা শবজির সালাদ। সঙ্গে গোরুর দুধ এক গ্লাস।”
চুনু মিয়া খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, “আটার রুটি বানানোর জন্যে বাবুর্চি লাগে?”
ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “লাগে। করতে পারলে বলো তোমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেব।”
“পারব স্যার। কোনো অসুবিধা নাই।”
সাথে সাথে চুন্নু মিয়ার চাকরি হয়ে গেল। সকালে দারোয়ান, স্কুল চলার সময় দপ্তরি, দুপুরবেলায় বাবুর্চি।
.
কয়েকদিনের মাঝেই সব কয়জন শিক্ষক নিয়ে স্কুলের কাজ শুরু হল। যেহেতু স্কুলঘরটা এখনও আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বিভিন্ন ক্লাসঘরে যাবার জন্যে কিছু মই লাগানো হয়েছে। শিক্ষকেরা মই দিয়ে উপরে-নিচে যাতায়াত করেন, ছাত্রদের মই লাগে না, এমনিতেই দেয়াল খামচে খামচে ক্লাসে উঠে যায়। কোন বয়সী বাচ্চাকে কী পড়ানো হবে মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে, সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে। স্কুলটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত প্রায় রোজই এসে দেখে যান, তাঁদের নিজেদের স্কুলে বাচ্চারা পড়াশোনা করছে, দুপুরে নাস্তা করছে, বিকেলে মাঠে খেলছে দেখে তাঁদের বুক দশহাত ফুলে যায়।
স্কুলে বাংলা ইংরেজি পড়াতেন মির্জা মাস্টার, কয়দিন দেখে ফরাসত আলিও বাচ্চাদের ইংরেজি পড়ানো শুরু করেছেন। তাঁকে দেখে ফারুখ বখতও একটু সাহস পেয়েছেন, বাচ্চাদের জন্যে তাই পৌরনীতির একটা ক্লাস খোলা হয়েছে। ফারুখ বখত রাত জেগে পড়াশোনা করে দিনের বেলা ক্লাস নিচ্ছেন, বিষয়বস্তুটির জন্যেই কি না জানা নেই তার ক্লাসে ছাত্রদের খুব বেশি মনোযোগ নেই।
দেখতে দেখতে বেশ গরম পড়ে গেছে, দিনরাত ফরাসত আলির চুল-দাড়ি কুটকুট করে। প্রতি বছর অনেক আগেই তিনি সব কেটেকুটে ফেলেন, এ-বছর অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর না পেরে একরাতে তিনি তার নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল-দাড়ি কামিয়ে পুরোপুরি মুসোলিনি হয়ে ফিরে এলেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে আগে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি, কিন্তু এবারে গুরুতর সমস্যা হয়ে গেল।
পরদিন ফরাসত আলি স্কুলে গিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে, আগে তাকে দেখে সবাই একটা সালাম ঠুকে দিত, কিন্তু আজকে সালাম ঠোকা দূরে থাকুক এমনভাবে তার দিকে তাকাতে লাগল যেন তিনি খুব অন্যায় কাজ করে ফেলেছেন। তিনি যখন স্কুলের নতুন কম্পিউটার-ঘরটা দেখতে গেলেন হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক মহসিন কম্পিউটার-ঘরে ঢুকে ফরাসত আলিকে দেখে চমকে উঠল। কাছে এসে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন?”