ফারুখ বখত থতমত খেয়ে বললেন, “না, ঠিক তা বলছি না।”
মেয়েটি আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনারা এক সেকেন্ড টেবিল থেকে সরে বসবেন?”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে না পারলেও টেবিল থেকে সরে দাঁড়ালেন। রুখসানা শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল। ডানহাতটা উপরে তুলে বামহাতটা সে নিজের সামনে ধরে দাঁড়াল। তারপর কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ সে গুলির মতো ছুটে আসে, ডানহাত দিয়ে টেবিলের মাঝখানে আঘাত করল আর সাথে সাথে টেবিলটা দুভাগ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রুখসানা হাত ঝেড়ে শাড়িটা আবার ঠিক করে পরে ফারুখ বখতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “সস্তা কাঠ! পাটশলার মতো ভেঙে যায়।”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি মিনিটখানেক কথা বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, “তুমি—মানে–আপনি, মানে–হাত দিয়ে–মানে তুমি—”
রুখসানা বলল, “থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। বড় কথা হচ্ছে ব্যালেন্স, শরীরের উপর ব্যালেন্স রাখতে হয়। জোরটা দিতে হয় ঠিক যেখানে প্রয়োজন। ছেলে মেয়ে বলে কোন কথা নেই। ছেলেরা যেটা পারে মেয়েরাও সেটা পারে।”
“অবশ্যি অবশ্যি।”
“তাই খেলাধুলার শিক্ষক হতে হলে ছেলে হতে হবে সেরকম কোন কথা নেই।”
রুখসানা তার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে আসি তাহলে।”
ফারুখ বখত বললেন, “কো-কো-কোথায় যাচ্ছেন?”
“চলে যাচ্ছি। আপনাদের কথাবার্তা শুনে বুঝে গেছি আপনারা মেয়েদের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন না। শুধু সময় নষ্ট করে কি হবে?”
রুখসানা চলে যেতে যেতে দরজার কাছে থেমে বলল, “টেবিলটার জন্যে দুঃখিত। আপনারা তো লটারিতে অনেক টাকা পেয়েছেন, আরেকটা কিনে নেবেন?”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি কিছু বলার আগে দরজা খুলে রুখসানা বের হয়ে গেল।
সেকেন্ড দশেক পরে হঠাৎ ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তারপর দুজনে দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে রুখসানাকে রাস্তায় গিয়ে ধরলেন। একেবারে হাতজোড় করে বললেন, “প্লিজ রুখসানা প্লিজ, তুমি যেয়ো না!”
ফরাসত আলি বললেন, “তোমার মতো একজন দরকার আমাদের স্কুলে।”
ফারুখ বখত বললেন, “আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ভারটা তুমি নাও!”
“যেভাবে তুমি করতে চাও, যা তুমি করতে চাও!”
“তুমি বলো তোমার কী লাগবে। এই মুহূর্তে তোমাকে চেক লিখে দেব।”
রুখসানা মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনারা এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, আপনারা যদি চান অবশ্যি আমি খেলাধুলার শিক্ষক হব! ছোট ছেলেমেয়েদের আমার খুব ভালো লাগে।”
কম্পিউটার আর খেলাধুলার শিক্ষক ছাড়াও তাঁদের একজন অঙ্ক আরেকজন বিজ্ঞানের শিক্ষক দরকার ছিল। অঙ্কের শিক্ষকটি তারা পেয়ে গেলেন খুব সহজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিটায়ার্ড অঙ্কের প্রফেসর, নাম ইদরিস আলি, সবাই ডাকে প্রফেসর আলি। ঘোর নাস্তিক মানুষ, অঙ্ক কষে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন ঈশ্বর বলে কিছু নেই। পুরো ব্যাপারটি নাকি শেষ পর্যন্ত একটা দ্বিমাত্রিক ইকুয়েশানে এসে শেষ হয়েছে। সেই ইকুয়েশানের দুইটি সম্ভাব্য উত্তর। একটি উত্তর সত্যি হলে ঈশ্বর আছে, আরেকটি সত্যি হলে ঈশ্বর নেই। এখন কোনটি সত্যি সেটা নিয়ে খুব সমস্যার মাঝে আছেন। পথচারী স্কুলের বাচ্চাদের অঙ্ক শেখানোর জন্যে অবিশ্যি সেটি কোনো সমস্যা নয়। কারণ ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত বারবার করে বলে দিয়েছেন এই স্কুলের বাচ্চারা হবে নতুন যুগের মানুষ, তার অর্থ নিজের ধর্মকে ভালোবাসবে এবং অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। কাজেই ঈশ্বর আছে কি নেই এ-ধরনের গুরুতর বিষয় নিয়ে তাদের যেন বিভ্রান্ত করে দেয়া না হয়। প্রফেসর আলি খানিকক্ষণ তর্ক করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন–তিনি তর্ক করতে ভালোবাসেন, প্রতিদিন ভোরে নাস্তা করার আগে কেন নাস্তা করতে হবে সেটা নিয়েও তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা তর্ক করেন। প্রফেসর আলি বলেছিলেন পথচারী স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্যে তিনি কোনো বেতন নেবেন না, কিন্তু ফারুখ বখত আর ফরসত আলি বলেছেন, বেতন না নিলে কেউ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে না। তিনি শেষ পর্যন্ত অল্প কিছু বেতন নিতে রাজি হয়েছেন।
অঙ্কের শিক্ষক সহজে পেয়ে গেলেও বিজ্ঞানের শিক্ষক পাওয়া খুব সহজ হল। অনেকেই ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল কিন্তু কাউকেই ফারুখ বখত আর ফরাসত আলির পছন্দ হয় না। তারা হারুন ইঞ্জিনিয়ারকে অনেকবার অনুরোধ করলেন কিন্তু হারুন ইঞ্জিনিয়ার কিছুতেই রাজি হলেন না, ছোট বাচ্চাদের তিনি খুব ভয় পান, তাদের থেকে তিনি সবসময় অন্তত একশো হাত দূরে থাকতে চান। তিনি স্কুলঘরটা সোজা করে বসিয়েই চলে যাবেন, তাঁর নাকি ইতালি বা আমেরিকা কোথায় গিয়ে বছরখানেক কাজ করতে হবে। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যাকে শেষ পর্যন্ত নেয়া হল তার নাম রাণু মুখার্জী, সবাই তাঁকে রাণুদিদি বলে ডাকে। তিনি স্কুল কলেজ পাস করেছেন অনেক আগে কিন্তু কখনো কোথাও কাজ করেননি, নিজের বাচ্চাদের মানুষ করেছেন। বাচ্চারা এখন কলেজে পড়ে তাই নিজের অনেক অবসর। এলাকার সবাই জানে তিনি খুব কাজের মানুষ, সবসময় কিছু-না-কিছু করছেন। তাঁর বাসায় ফুলের টবে নানারকম শবজি গাছ লাগানো। বিচিত্র সব শবজি, শসা এবং কুমড়া একত্র করে তৈরি হয়েছে শমড়া, জিনিসটা দেখতে কুমড়ার মতো বড় কিন্তু খেতে শসার মতো। টমেটো আর বেগুন দিয়ে তৈরি হয়েছে টমেন যেটা দেখতে খানিকটা বেগুনের মতো আবার খানিকটা টমেটোর মত। সেটা ব্যবহার করে বেগুনের টক রান্না করার সময় আলাদা করে আর টক দিতে হয় না, কারণ টমেগুন খেতে টক বেগুনের মতো। রাণুদিদির আরও নানাধরনের আবিষ্কার রয়েছে, সূর্যের আলো ব্যবহার করে পানি গরম করা কিংবা রান্না করা তার মাঝে একটা। বাসার ছাদে একটা বিরাট অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি ঝুলিয়ে একবার উপগ্রহ থেকে কিছু সিগন্যাল ধরেছিলেন। তিনি এখন বাসার নিচে অনেকগুলি ক্যাপাসিটর জড়ো করেছেন, বজ্রপাতের সময় সেই ক্যাপাসিটর চার্জ করে সেটা ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি বিজ্ঞানের জন্যে ভালো কোনো শিক্ষক না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রাণুদিদির শরণাপন্ন হয়েছেন। প্রথমে রাজি হননি কিন্তু পথচারী স্কুলের কর্মকাণ্ড শুনে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন কয়েকদিন কাজ করে দেখবেন।