ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখতের মহসিনকে খুব পছন্দ হল। তখন তখনই তাকে তারা একটা চেক লিখে পথচারী স্কুলের কম্পিউটারের সব দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।
কম্পিউটারের শিক্ষকের পর তাঁরা খেলাধুলার জন্যে একজন শিক্ষক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। ইন্টারভিউ দিতে প্রথম যে-মানুষটি এসে হাজির হল তাকে দেখে তাদের চোখ কপালে উঠে গেল। মানুষটি শুকনো হাড়জিরজিরে, গাল ভেঙে মুখের ভিতরে ঢুকে গেছে, চোখ গর্তের ভিতরে। মানুষটির গায়ের চামড়া এবং দাঁত হলুদ রঙের। ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে মানুষটি কাশতে শুরু করল, ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতের মনে হতে লাগল কাশতে কাশতে এই চেয়ারেই মানুষটির দম আটকে পড়ে যাবে এবং এক্ষুনি স্ট্রেচারে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল, তখন ফারুখ বখত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোন পোস্টে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”
“কেন, খেলাধুলার শিক্ষক!”
“কিন্তু খেলাধুলার শিক্ষকদের অনেক শক্তসমর্থ হওয়া দরকার। দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, পি.টি. স্পোর্টস, সাঁতার ফুটবল ক্রিকেট, আপনি কি পারবেন এইসব?”
মানুষটি কথা বলতে গিয়ে আবার কাশতে শুরু করল এবং কাশি শেষ হবার আগেই তার হাঁপানির টান শুরু হয়ে গেল। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইলেন এবং মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বছরের এই সময়টা আমি মোটামুটি ভালো থাকি, এই সময়ে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু—”
ফারুখ বখত ইন্টারভিউয়ের খাতায় মানুষটির নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’।
এর পরে যে-মানুষটি এসে ঢুকল তাকে একটা ছোটখাটো দৈত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়, ঘরে ঢোকার সময় তার দরজায় মাথা ঠুকে গেল। তার বুকের সিনা দুই মিটারের এক সেন্টিমিটার কম না। হাতের মাংসপেশি দেখে মনে হয় বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী কিলবিল করছে। ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি দুজনেই তাকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন।
মিনি দৈত্যটি তাদের সামনে চেয়ারে বসার পর ফরাসত আলি বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই খেলাধুলায় শিক্ষকের জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”
“হাঁহ?”
ফরাসত আলি আবার প্রশ্নটি করলেন এবং মিনি দৈত্যকে খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল। ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করলেন। এবারে মিনি দৈত্য সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “হাঁহ!”
ফারুখ বখত তাঁর বলপয়েন্ট কলমটা টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করার ব্যাপারে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?”
“হাঁহ?” ফারুখ বখত আবার প্রশ্নটি করলেন এবং মিনি দৈত্য আবার বলল, “হাঁহ?”
ফরাসত আলি অনেকক্ষণ চিন্তা করে এবারে জিজ্ঞেস করলেন, “ফুটবল ক্রিকেট ভলিবল এইসব খেলা আপনি জানেন?”
“হাঁহ?”
এতক্ষণে তারা দুইজনে বুঝে গেছেন এই বিশাল মানুষের শক্তিশালী দেহটির নিয়ন্ত্রণে যে-মস্তিষ্কটি আছে সেটি আকারে খুবই ছোট, লবণের চামচে দুই চামচের বেশি হবার কথা নয়। ছোট বাচ্চাদের খেলাধুলর দায়িত্বে এই মানুষটিকে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। ফারুখ বখত তার নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’।
এরপর যে-মানুষটি ইন্টারভিউ দিতে এল সে খুব লম্বা নয় কিন্তু তার পেটা শরীর। মানুষটি শার্টের হাতা গুটিয়ে তাদের সামনে বসে দাঁত বের করে হেসে বলল, “কেমুন আছেন ওস্তাদ?”
ফারুখ বখত আর ফরাসত আলিকে এর আগে কেউ ওস্তাদ বলে ডাকেনি তাই তারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভালো।”
ফরাসত আলি তার কাগজপত্র দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “খেলাধুলার ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে?”
“কী বুলেন আপনি! জেইলখানায় আমার কাবাডি টিম ছিল চ্যাম্পিয়ান।” ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি দুজন একসাথে চমকে উঠে বললেন, “জেলখানায়?”
“হুঁ হুঁ।“
“জেলখানায় আপনি কী করতেন?”
“জেইলখানায় কী করে মানুষে? কয়েদ খাটে। হা হা হা!”
“কেন গিয়েছিলেন আপনি জেলে?”
“মার্ডার কেস।”
“মার্ডার কেস?”
মানুষটি পিচিক করে মেঝেতে থুতু ফেলে বলল, “খামাখা কোট কাঁচারী! জজ সাহেবের লাশ ফেলে দেয়া দরকার ছেল–”
ফরাসত আলি ঢোক গিলে বললেন, “আপনি জজ সাহেবকে খুন করার কথা বলছেন?”
লোকটা মনে হল একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “এত অবাক হচ্ছেন কেন? খুন খারাপি করেন নাই কুনোদিন?”
ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত কোনোদিন খুন-খারাপি করেননি শুনে লোকটা খুব অবাক এবং হতাশ হল। মেঝেতে পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেলে বলল, “যার যেইটা লাইন।
ফারুখ বখত সাবধানে এই মানুষটির নামের পাশে বড় বড় করে লিখলেন, ‘বাতিল’!
খেলাধুলার শিক্ষক হিসেবে শেষ পর্যন্ত যাকে নেয়া হল সে কমবয়সী একটা মেয়ে। মেয়েটি হালকা পাতলা, চেহারার মাঝে একটা উদাস-উদাস ভাব। কথা বার্তা খুব সুন্দর করে বলে শুনলে মনে হয় কেউ বুঝি টেলিভিশনে খবর পড়ছে। মেয়েটিকে দেখে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি মনে-মনে তাকে বাতিল বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাদের ধারণা ছিল খেলাধুলার শিক্ষক হতে হবে গাট্টাগোট্টা একজন পুরুষ। যখন কথাবার্তা শুরু হল ফারুখ বখত বললেন, “খেলাধুলার ব্যাপার, বুঝতেই পারছেন ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, মেয়েদের
কমবয়েসী মেয়েটি–যার নাম রুখসানা হক, মিষ্টি করে হেসে বলল, “আপনি ভাবছেন মেয়েরা ছেলেদের মতো দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করতে পারে না?”