সাইনবোর্ড লাগানো শেষ হওয়ার আগেই হারুন ইঞ্জিনিয়ার এসে হাজির হলেন, নাকের উপর চশমাটি ভালো করে বসিয়ে তিনি সাইনবোর্ডের পুরো লেখাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে ভুরু কুঁচকে ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখতের দিকে তাকালেন। ফারুখ বখত একগাল হেসে বললেন, “ভালো হয়েছে না সাইনবোর্ডটা?”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নেড়ে বললেন, “সাইনবোর্ডে এতসব করবে বলে লিখেছ কিন্তু তোমার মাস্টার হচ্ছে মাত্র একজন। মির্জা মাস্টার।”
ফরাসত আলি বললেন, “মির্জা মাস্টার একাই একশো।”
“আমি ওজনের কথা বলছি না!”
ফরাসত আলি থতমত খেয়ে বললেন, “আমি আসলে সেটা বলছিলাম না। মির্জা মাস্টার সাংঘাতিক ভালো মাস্টার, একাই সবকিছু পড়াতে পারেন–”
“কিন্তু ঐ যে কম্পিউটার সায়েন্সের কথা লিখেছ? চিকিৎসা, খাবার সেগুলি কে করবে?”
ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “তার জন্যে আমাদের লোক খুঁজে বের করতে হবে। সব বিষয়ের জন্যে একজন করে শিক্ষক, একজন ডাক্তার আর একজন বাবুর্চি।”
“বাবুর্চি?”
“হ্যাঁ, বাচ্চাদের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রান্না করতে হবে না?”
“এতসব করবে কখন?”
ফরাসত আলি বললেন, “কোনো চিন্তা করবে না। লটারিতে তিরিশ লাখ টাকা পেয়েছি, পুরো টাকাটা খরচ করা হবে এই স্কুলের পিছনে।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার চশমা খুলে তার কাঁচগুলি পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “তা ঠিক।”
পরের দিনই খবরের কাগজে শিক্ষকদের জন্যে বিজ্ঞাপন দেয়া হল। এক সপ্তাহের মাঝে আবেদনপত্র জমা হতে শুরু করল এবং ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত তাদের ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন। ব্যাপারটি যত সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল মোটেই তত সহজ হল না। যেমন ধরা যাক কম্পিউটারের শিক্ষকের কথা। প্রথমে যে এল তার চোখে কালো চশমা এবং মুখে সিগারেট। ফারুখ বখত বললেন, “আমাদের এটা বাচ্চাদের স্কুল, সিগারেট খাওয়া একেবারে বন্ধ করার চেষ্টা করছি।”
কালো চশমা চোখের মানুষটি সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “এটা বিদেশি সিগারেট। আমি দেশি সিগারেট খাই না।”
“দেশি-বিদেশি জানি না, আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।”
শুনে লোকটা হে হো করে হেসে উঠল যেন তিনি খুব একটা মজার কথা বলেছেন। ফারুখ বখত তখন তার ইন্টারভিউয়ের খাতায় লোকটির নামের পাশে কাটা চিহ্ন দিয়ে লিখলেন ‘বাতিল’।
পরের মানুষটির মুখে এক ধরনের সবজান্তা সবজান্তা ভাব। ফারুখ বখত আর ফরাসত আলি হাত ধরে খুব জোরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “স্কুলের বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখানোটা খুব ভালো আইডিয়া।”
ফরাসত আলি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কম্পিউটার বিষয়ে অভিজ্ঞ?”
“বলতে পারেন। আমার বন্ধুর ছোটভাইয়ের একটা কম্পিউটার আছে, আমি কয়েকবার দেখেছি।”
“দেখেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কখনো ব্যবহার করেননি?”
“আপনাদের স্কুলে জয়েন করেই ব্যবহার করব।”
ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “বাচ্চা ছেলেদের কম্পিউটার ব্যবহার করা শেখাতে হবে, প্রোগ্রামিং করা শেখাতে হবে, আপনি কেমন করে সেটা করবেন?”
সবজান্তা চেহারার মানুষটা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আপনারা ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমি উপমন্ত্রীর ছোটভাইয়ের সাক্ষাৎ শালা”
ফারুখ বখত সবজান্তা মানুষটাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা তো শালা-সম্বন্ধীকে খুঁজছি না, কম্পিউটারের একজন মাস্টার খুঁজছি। আপনি এখন আসেন”
তারপর তিনি তার ইন্টারভিউয়ের খাতায় সবজান্তার নামের পাশে বড় করে লিখলেন ‘বাতিল’।
এর পরের যে-মানুষটি এল সে একেবারে সাদাসিধে চেহারার। ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কম্পিউটার সম্পর্কে জানেন শোনেন?”
“কম্পিউটার?” লোকটা খুব অবাক হয়ে ফারুখ বখতের দিকে তাকাল।
”হ্যাঁ, কম্পিউটার।” ফারুখ বখত আরও অবাক হয়ে সাদাসিধে লোকটার দিকে তাকালেন।
সাদাসিধে লোকটা মাথা চুলকে বলল, “কম্পিউটার কী সেটা তো আমি জানি না। আমি ভাবছিলাম আপনারা জিরক্স করার কপি মেশিনের কথা বলছিলেন। সেটা আমি খুব ভালো করে জানি। উপরে কাগজটা দিয়ে ডানদিকে টিপি দিতে হয়। তখন কাগজটা কপি হয়ে বের হয়ে আসে।”
ফারুখ বখত হাসি চেপে বললেন, “কিন্তু আমরা তো জিরক্স করার কপি মেশিনের জন্যে মানুষ খুঁজছি না, আমরা খুঁজছি কম্পিউটার মাস্টার।”
তারপর তার নামের পাশে ছোট ছোট করে লিখলেন, ‘বাতিল’।
এইভাবে একজনের পর আরেকজন বাতিল হয়ে শেষ পর্যন্ত যে-মানুষটিকে নেয়া হল তার নাম মুহম্মদ মহসিন। তার বয়স বেশি না, দেখে মনে হয় বুঝি স্কুলের ছাত্র। সে কলেজে পড়তে পড়তে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাজারের কাছে কম্পিউটারের একটা দোকানে বসে কাজ শুরু করেছিল। কয়েকদিনের মাঝে আবিষ্কার করল কম্পিউটার কেমন করে ব্যবহার করতে হয় ব্যাপারটা সে খুব ভালো বোঝে। কম্পিউটারের দোকানের মালিকের সাথে তার কী-একটা গোলমাল হওয়ার পর সে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। কম্পিউটারগুলিতে সে কী করে এসেছে কেউ জানে না, কিন্তু প্রতি বুধবার বেলা এগারোটার সময় কম্পিউটারগুলি হঠাৎ মোটা গলায় সুর করে বলে–
জব্বার ভাই
চামড়া দিয়া জুতা বানাই
দোকানের মালিক জব্বার আলি ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি বুধবার বেলা এগারোটার সময় তার দোকান এক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ করে দেন। শোনা যাচ্ছে তিনি তার কম্পিউটারগুলি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সুবিধা করতে পারছেন না।