হারুন ইঞ্জিনিয়ার রেগে উঠে বললেন, “তখনই বলেছিলাম এরকম পাগলামি করতে যাবেন না, স্কুলঘরটাকে সোজা করেন–কিন্তু আমার কথা শুনলেন না।”
ফরাসত আলি বললেন, “এখন তো রাগ-গোস্বার সময় না, এখন হচ্ছে ক্রাইসিসের সময়। কিছু-একটা বুদ্ধি বের করো তাড়াতাড়ি।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা চুলকে বললেন, “বুদ্ধি বের করার কী আছে? একটা কপিকল বেঁধে মির্জা মাস্টারকে টেনে তুলতে হবে উপরে।”
“আছে কপিকল?”
“হ্যাঁ, আছে কয়েকটা। শক্ত নাইলনের দড়িও আছে।”
“তাহলে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই। শুরু করে দাও।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার গম্ভীর হয়ে বললেন, “সমস্যার সমাধান না করে সেটাকে রেখে দিতে হয় না, সেটা শুধু নতুন সমস্যা তৈরি করে।”
ফরাসত আলি দাঁত বের করে হেসে বললেন, “যদি কোনো সমস্যা না থাকে তা হলে আর বেঁচে থাকার আনন্দ কোথায়?”
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল স্কুলঘরের উপরে শক্ত একটা কপিকল লাগানো হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে নাইলনের শক্ত দড়ি ঢোকানো হয়েছে, দড়ির এক মাথায় মির্জা মাস্টারকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হল, অন্য মাথায় হাত লাগাল উপস্থিত দর্শকদের প্রায় শদুয়েক উৎসাহী ভলান্টিয়ার।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার হাতে একটা রুমাল নিয়ে একবার উপর দিকে তাকালেন, একবার মির্জা মাস্টারের বিশাল দেহের দিকে তাকালেন, তারপর উৎসাহী ভলান্টিয়ারদের দিকে তাকিয়ে তার রুমালটি নেড়ে বললেন, “মারো টান–”
শদুয়েক মানুষ একসাথে নাইলনের দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারে, সবাই আশা করেছিল মির্জা মাস্টার বুঝি মিটারখানেক উপরে উঠে যাবেন, কিন্তু তিনি উপরে উঠলেন না। সবাই সবিস্ময়ে দেখল স্কুলঘরটি মিটারখানেক বাঁকা হয়ে গেল।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নেড়ে বললেন, “ভয় পাবেন না। আবার টান মারেন”
উপস্থিত লোকজন হাইয়ো’ বলে আবার হ্যাঁচকা টান মারে। এবারে মির্জা মাস্টার খানিকটা উপরে উঠলেন, শূন্য থেকে ঝুলছেন বলে তাঁকে দেখায় একটা অতিকায় মাকড়শার মতো। তার হাত-পা ইতস্তত নড়তে থাকে এবং মনে হয় মাকড়শাটি উপর থেকে ঝুলছে।
উপস্থিত লোকজন প্রচণ্ড উৎসাহে আবার হ্যাঁচকা টান মারে এবং মির্জা মাস্টার আরেকটু উপরে উঠে যান। ধীরে ধীরে তিনি উপরে উঠতে থাকেন এবং উপর থেকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা প্রচণ্ড চাঁচামেচি করে উৎসাহ দিতে থাকে। হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার রুমাল নাড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘মারো টান’, অন্য সবাই বলে ‘হাইয়ো’ এবং সত্যি সত্যি মির্জা মাস্টার উপরে উঠে এলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি একটা দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন এবং দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাকে খামচে ধরে ফেলে টেনে ক্লাসঘরের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলে। সাথে সাথে উপস্থিত দর্শকেরা চিৎকার করে হাততালি দিয়ে জায়গাটি সরগরম করে দেয়।
মির্জা মাস্টার ক্লাসঘরে পৌঁছানোর পর ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ফরাসত আলি বললেন, “যাক বাবা বাঁচা গেল। প্রথমদিন স্কুল যদি ঠিক করে শুরু করা না যেত মনটা খুঁতখুঁত করত।”
ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “স্কুল ঠিক করে হচ্ছে কি না তুই কেমন করে জানিস? হয়তো ক্লাসঘরে ঢুকতে গিয়ে মির্জা মাস্টার ব্যথা পেয়েছেন। হয়তো লম্বা হয়ে পড়ে আছেন, ছাত্ররা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়েছেন—”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “না, মির্জা মাস্টার ভালোই আছেন, ক্লাস নিতে শুরু করেছেন।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি জানি। এইমাত্র ডানদিকে হেঁটে গেলেন–”
ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললে, “তুই কেমন করে জানিস?”
“তাকিয়ে দ্যাখ। পুরো স্কুলঘরটা ডানদিকে বাঁকা হয়ে আছে। হঠাৎ সেটা সোজা হয়ে গেল, তারপর আবার বামদিকে বাঁকা হয়ে গেল।” ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “মির্জা মাস্টার বামদিকে গেলেন।”
ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি সবিস্ময়ে স্কুলঘরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পেলেন পুরো স্কুলঘরটা একবার দুলে উঠল।
ফরাসত আলি চমকে উঠে বললেন, “কী হল হঠাৎ?”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মনে হয় মির্জা মাস্টার একটা হাঁচি দিলেন।”
০৪. পরদিন ভোরে ফারুখ বখত
পরদিন ভোরে ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি তাদের স্কুলের সামনে একটা বিশাল সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেন। সাইনবোর্ডে বিরাট বড় করে লেখা :
পথচারী মডার্ন স্কুল
তার নিচে আরেকটু ছোট ছোট অক্ষরে লেখা :
এখানে বিনামূল্যে যে-কোনো শিশুকে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হয়।
তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :
শিশুদের বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার ব্যবহার ও প্রোগ্রামিং শেখানো হয়।
তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :
শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়া হয়, চিকিৎসা ও খেলাধুলার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :
শিশুদের জাতি ধর্ম বর্ণ ও সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে বিশ্বমানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।
তার নিচে আরেকটু ছোট অক্ষরে লেখা :
শিশুদের পারিবারিক মূল্যবোধ নৈতিকতা এবং নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়া হয়।
সাইনবোর্ডের নিচে আর কিছু লেখার জায়গা নেই, যদি থাকত সেখানে যে আরও কিছু লেখা হত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।