মির্জা মাস্টার আবার একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার চশমা খুলে জোরে জোরে কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “আপনি আসলে আমাদের সাথে মশকরা করছেন, তাই না?”
মির্জা মাস্টার তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে যতদূর সম্ভব উপরে তুলে বললেন, “আমি কখনো মশকরা করি না। সত্যি সত্যি বলছি।”
ফারুখ বখত খানিকক্ষণ কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলটাকে দেখলেন, বাচ্চাদের হৈচৈ আনন্দোচ্ছ্বাস শুনলেন, তারপর মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যদি পড়ে ব্যথা পায়?”
“পাবে না।” মির্জা মাস্টার মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যথা পাবে না। এরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে, স্টিমার থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তরতর করে সুপারি গাছ বেয়ে উঠে যায়–এরা কখনো পড়ে ব্যথা পাবে না। এরা বড়লোকের ন্যাদান্যাদা বাচ্চা না, এদের নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।”
ফারুখ বখত বললেন, “ঠিক আছে, তা হলে কয়েকদিন স্কুলঘরটাকে এভাবেই রাখা যাক। এটাকে সোজা করার এত তাড়াহুড়ো কী?”
মির্জা মাস্টার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।
ফরাসত আলি স্কুলঘরটার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে তা হলে থাকুক এইভাবে।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার হঠাৎ করে খুব রেগে উঠলেন, গলা উঁচিয়ে বললেন, “তোমাদের সবার মাথা-খারাপ হয়েছে, তা-ই না?”
ফারুখ বখত বললেন, “কেন? মাথা-খারাপ হবে কেন? মির্জা মাস্টার এত করে চাইছেন, তাই কয়েকদিন স্কুলটাকে এভাবে রাখা হচ্ছে, তার বেশি কিছু না।”
“আর আমার মান-সম্মান? লোকজন বলাবলি করবে হারুন ইঞ্জিনিয়ার ঘরবাড়ি তৈরি করে উলটো। এরপর আমার কাছে কেউ কোনোদিন আসবে?”
“আসবে না কেন? একসোবার আসবে।” ফারুখ বখত সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “এটা তো পাকাঁপাকিভাবে রাখা হচ্ছে না। কয়েকদিনের জন্যে রাখা হচ্ছে।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে খুব রেগেমেগে চুপ করে রইলেন।
.
পরদিন ভোরে স্কুলের আশেপাশে অনেক ভিড়। এলাকার যত বাচ্চা ছেলেপিলে আছে তারা সবাই চলে এসেছে। কীভাবে জানি খবর চলে গেছে যে এই স্কুলঘরে পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ভিড়ের বেশির ভাগ অবিশ্যি মজা দেখার জন্যে এসেছে, সবাই স্কুলটাকে ঘিরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পান-সিগারেটের দোকান বেশ কয়েকটা খুলে গেছে, ঝালমুড়ি এবং চানাচুর নিয়ে কিছু ছেলেপিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠলে তারাও নাকি ক্লাসঘরে ঢুকে পড়বে। কৌতূহলী দর্শক ছাড়াও রয়েছে খবরের কাগজের সাংবাদিক। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলে তারা, নোটবইয়ে কীসব লেখালেখি করছে। টেলিভিশন থেকেও লোক এসেছে, মস্ত বড় ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে তারা এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।
সকাল আটটা বাজতেই বিশাল একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়া হল এবং হঠাৎ করে দেখা গেল পিলপিল করে নানা আকারের ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে স্কুলঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা দেয়াল খিমচে খিমচে সুপারি গাছের মতো স্কুলঘর বেয়ে উঠতে থাকে এবং আড়াআড়ি দরজা-জানালার মাঝে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করে। বাচ্চাদের হৈচৈ এবং আনন্দ-চিৎকারে জায়গাটা কিছুক্ষণের জন্য সরগরম হয়ে যায়। স্কুলঘরের দরজা-জানালা ছাদ এবং মেঝের মাঝে দিয়ে দুরন্ত ছেলেরা লাফঝাঁপ দিতে থাকে এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল জনতা সার্কাস দেখার মতো সেটা উপভোগ করতে থাকে। লোকজনের হৈচৈ দেখে জায়গাটাকে ঠিক স্কুলের মতো মনে না হয়ে একটা বাজারের মতো মনে হচ্ছিল।
.
উপস্থিত সব লোকজন হঠাৎ করে চুপ করে যায়–দেখা গেল মির্জা মাস্টার তার বিশাল দেহ নিয়ে থপথপ করে এগিয়ে আসছেন। তিনি কীভাবে কাত হয়ে থাকা এই স্কুলঘরের দেয়াল খিমচে খিমচে উপরে উঠবেন সেটি দেখার জন্যে বিশাল জনতা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে।
মির্জা মাস্টার স্কুলঘরের নিচে দাঁড়িয়ে ফ্যাকাশে মুখে একবার উপরে তাকালেন। কয়েক পা এগিয়ে তিনি স্কুলঘরের প্রায়-মসৃণ দেয়ালটি স্পর্শ করে হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন হিসেবে একটি ছোট গোলমাল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক ঘরের স্বাভাবিক দরজা দিয়েই তাকে মোটামুটি কসরত করে ঢুকতে হয়, এই কাত হয়ে থাকা স্কুলের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আড়াআড়ি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা তার জন্যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। সোজা রাস্তায় দশ পা হাঁটলেই তাঁকে খানিকক্ষণ বসে নিঃশ্বাস নিতে হয়, এই স্কুলঘরের দেয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলে তার হার্টফেল করে মরে যাওয়া বিচিত্র কিছু না।
স্কুলের উপর থেকে নানা ধরনের ছাত্রছাত্রীরা দরজা-জানালা এবং ফাঁকফোকর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে তাঁকে ডাকাডাকি করতে থাকে, মির্জা মাস্টার ঠিক কী করবেন বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ফারুখ বখত, ফরাসত আলি এবং হারুন ইঞ্জিনিয়ার অন্যান্য কৌতূহলী মানুষদের সাথে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটি লক্ষ করছিলেন এবং মির্জা মাস্টারের বিশাল দেহটিকে উপরে তোলার জটিল সমস্যাটার কথা তারাও মোটামুটি একই সাথে বুঝতে পারলেন। ফারুখ বখত গলা নামিয়ে বললেন, “এখন কী করা যায়? এত মানুষজন দাঁড়িয়ে দেখছে যদি শিক্ষক ছাত্রদের কাছে যেতে না পারে তা হলে তো খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।”