ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন।
মির্জা মাস্টার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আসলে ঠাট্টা করছেন, তাই না? আসলে এটা বড়লোকের বাচ্চাদের জন্যে স্কুল। তারা যেন পাস করেই বিলাত আমেরিকা যেতে পারে। তাই না?”
ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “না। আজ থেকে এটা আপনার ছাত্রদের স্কুল।”
মির্জা মাস্টার হঠাৎ তার বিশাল শরীর নিয়ে থপথপ করে স্কুলের মাঠে ছুটে যেতে থাকলেন। মাঠের মাঝামাঝি গিয়ে তিনি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “পথচারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা–”
হঠাৎ উপস্থিত লোকজনের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলি বাচ্চা মির্জা মাস্টারকে ঘিরে দাঁড়াল, তাদের পায়ে জুতো নেই, শরীরে কাপড় নেই, ছোট কয়েকজনের নাক থেকে সর্দি ঝরছে। কয়েকটি বাচ্চা মেয়ে, তাদের কোলে আরও ছোট ন্যাদান্যাদা বাচ্চা।
মির্জা মাস্টার তার ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে দেখছ স্কুলঘর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, এই স্কুল এখন থেকে তোমাদের।
“আমাদের?”
“হ্যাঁ।”
“খোদার কসম?”
মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “কথায়-কথায় তোমাদের সাথে আমার কসম কাটতে হবে? বলেছি বিশ্বাস হয় না?”
উপস্থিত বাচ্চাগুলি মাথা নাড়ল, না তাদের বিশ্বাস হয় না।
মির্জা মাস্টার হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন, “আমি তোমাদের শিক্ষক। শিক্ষক হচ্ছে বাবার মতো। বাবারা কি তার ছেলেমেয়েকে মিথ্যা কথা বলে?”
উপস্থিত বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা মাথা নেড়ে বলল, “জে, বলে।”
মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “কিন্তু আমি বলি না। এটা তোমাদের স্কুল।”
কালো ঢ্যাঙামতন একজন বলল, “আমরা যদি দালানটা ছুঁই তা হলে সাহেবেরা রাগ করবে না?”
“না, রাগ করবে না।”
“গিয়ে ছুঁয়ে দেখব?”
”যাও দ্যাখো।”
বলমাত্র একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, হঠাৎ করে পুরো শিশুর দল স্কুলঘরের দিকে ছুটে যায়। তারা স্কুলঘরের কাত হয়ে শুয়ে থাকা দালানটি ছুঁয়ে দেখে। একজন দুজন দরজা-জানালা বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। কয়েকজন আড়াআড়িভাবে বসানো দরজায় ফাঁক দিয়ে নিচের একটা ক্লাসঘরে ঢুকে যায়। কাত হয়ে থাকা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাচ্চাগুলি দেয়াল থেকে বের হয়ে থাকা বেঞ্চে ঝুলছে। ঘরের ভেতর থেকে হৈচৈ এবং আনন্দধ্বনি শোনা যেতে থাকে।
ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, “ঢুকল কেমন করে ভিতরে?”
ফারুখ বখত হাসিমুখে বললেন, “ছোট বাচ্চাদের ব্যাপার! তাদের অসাধ্য কিছু নাই।” সত্যি সত্যি তাদের অসাধ্য কিছু নেই। দেখা গেল বাচ্চাগুলি দেয়াল খিমচে ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। পিছনে একটা বাচ্চাকে ঝুলিয়ে একটা ছোট মেয়ে বিপজ্জনকভাবে একটা জানালা দিয়ে ঢুকে গেল। কয়েকজনকে দেখা গেল একটা দরজা দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে ভিতরে কোথায় জানি লাফিয়ে পড়ছে। ছোট ছোট কয়েকটি শিশুকে ছুটতে দেখা গেল, মনে হল একজন তাদেরকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে কালোমতন একটা বাচ্চা একটা জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হল, উপর থেকে নিচে পড়তে পড়তে সে নিজেকে সামলে নিল, দেয়াল বেয়ে পিছলে সে নিচে নেমে আসতে থাকে। দেখে মনে হয় ছেলেটির ভয়ংকর ফূর্তি হচ্ছে।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার চশমা মুছতে মুছতে পাংশুমুখে বললেন, “ছেলেগুলি পড়ে ব্যথা পাবে না তো?”
ফারুখ বখত ভুরু কুচকে বললেন, “শুধু ছেলে বলছ কেন? কমপক্ষে একডজন মেয়েও আছে ওখানে। ওই দ্যাখো, ঘাড়ে একটা বাচ্চা নিয়ে কীভাবে লাফ দিল! ইশ! ফারুখ বখত আতঙ্কে তার চোখ বন্ধ করে ফেললেন।”
ফরাসত আলি বললেন, “আমাদের কথা তো শুনবে বলে মনে হয় না।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নাড়লেন, “না। শুনবে না।”
ফাসত আলি তাঁর দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “মির্জা মাস্টারের কথা শুনবে, হাজার হলেও তাদের শিক্ষক। তাঁকে বলতে হবে।”
ফরাসত আলি হন্তদন্ত হয়ে মাঠের মাঝে হেঁটে যেতে লাগলেন, তাঁর পিছুপিছু ফারুখ বখত, ফারুখ বখতের পিছুপিছু হারুন ইঞ্জিনিয়ার। এই তিনজনকে হেঁটে আসতে দেখে মির্জা মাস্টার তাঁদের দিকে তাকালেন, তাঁর গোলগাল মুখে নাক চোখ মুখ এত ছোট ছোট দেখায় যে সেখানে কোনো ধরনের অনুভূতিরই ছাপ পড়ে না। তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীর কাজকর্ম দেখে তিনি কতটুকু ভয় পেয়েছেন বোঝা গেল না। ফরাসত আলি বললেন, “মির্জা মাস্টার! আপনার কি মনে হয় না যে ছেলেমেয়েগুলি যেভাবে লাফঝাঁপ দিচ্ছে–”
“ঠিকই বলেছেন।” মির্জা মাস্টার মাথা নেড়ে বললেন, “ছেলেমেয়েগুলি যেভাবে লাফ দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের স্কুলটা অসম্ভব পছন্দ হয়েছে।”
“আমি সেটা বলছি না।” ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “আমি যেটা বলতে যাচ্ছি–”
“বুঝেছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন।” মির্জা মাস্টার একগাল হেসে বললেন, “আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি। স্কুলঘরটা এইভাবে কাত হয়েই থাকুক। এটাকে সোজা করে কাজ নেই।”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললেন? স্কুলটাকে সোজা করে কাজ নেই?”
“না! এই ছেলেপিলেরা কিছুতই স্কুলঘরে ঢুকতে চায় না। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা স্কুলঘরের মাঝে ঢোকানো, কিন্তু কাত হয়ে থাকা এই স্কুলঘর দেখে এরা এত মজা পেয়েছে আমার মনে হয় স্কুলটা এভাবে রেখে দিলেই হয়। সবাই তা হলে প্রত্যেকদিন স্কুলে আসবে।”
ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “স্কুলটা ঠিক করা হবে না? এইভাবে কাত হয়ে থাকবে? দরজা-জানালা আড়াআড়ি? মেঝে আকাশে উঠে যাচ্ছে?”