একসাথে অনেকগুলি কথা বলে ফেলে মির্জা মাস্টার মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।
হারুন ইঞ্জিনিয়ার চশমা খুলে কাঁচটা খুব মনোযোগ দিয়ে খানিকক্ষণ পরিষ্কার করে বললেন, “কীরকম স্কুল আপনার?”
“গরিব বাচ্চাদের। যেসব বাচ্চাকাচ্চা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, মিনতি টোকাইয়ের কাজ করে তাদের স্কুল।”
হঠাৎ করে ফারুখ বখত, ফরাসত আলি আর হারুন ইঞ্জিনিয়ার তিনজন একসাথে মির্জা মাস্টারের দিকে ঘুরে তাকালেন। ফারুখ বখত কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি গরিব বাচ্চাদের পড়ান?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার স্কুলের খরচ কে দেয়?”
“আমার স্কুলের কোনো খরচ নাই, কেউ দেয় না। বাচ্চারা আসে আমি তাদের পড়াই।”
“কী পড়ান?”
“প্রথমে পড়তে শেখাই। তারপরে অঙ্ক। তারপরে যে যেটা পড়তে চায়। কেউ ইংরেজি, কেউ সায়েন্স।”
“আপনার কতজন ছাত্র?”
“ঠিক নাই। ধান কাটার মৌসুমে কমে যায়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটু বেশি হয়। অনেক রকম ছাত্র আমার, কেউ বাসায় কাজ করে, কেউ মিনতি, কেউ মুটে, কেউ টোকাই। কেউ রেলস্টেশনে কুলি। দুইজন আছে পকেটমার।”
“পকেটমার?”
“জি। এইখানে পকেটমারদের একটা কলেজ আছে, দুইজন এখনই চান্স পেয়ে গেছে। চমৎকার হাতের কাজ। আপনার পকেট খালি করে দেবে আপনি টের পর্যন্ত পাবেন না। কলেজের প্রিন্সিপাল বলেছে এই দুইজন নাকি বড় হয়ে কলেজের সুনাম রাখবে।”
“আপনি পকেটমার কলেজের প্রিন্সিপালকে চেনেন?”
“না, ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। তারা পরিচয় গোপন রাখে। আমি লোকমুখে খবর পাই।”
ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এখন আপনার স্কুল উড়ে গেল, ছাত্রদের কী অবস্থা?”
“ছাত্ররা মহাখুশি। একেবারে পড়ায় মনোযোগ নাই। এরা গরিব মানুষের পোলাপান, বাসায় পড়াশোনার আবহাওয়া নেই–পুরো ব্যাপারটা মনে করে একটা ঠাট্টা-তামাশা।”
“ঠাট্টা তামাশা?”
“জি। কখনো ধমক দিয়ে কখনো আদর করে পড়াতে হয়। অনেক যন্ত্রণা।”
ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আপনার ছাত্ররা কোথায়?”
“এইখানেই আছে নিশ্চয়। দিনরাত সবগুলি টোটো করে ঘোরাঘুরি করে। যেখানে একটু হৈচৈয়ের খোঁজ পায় সেখানে হাজির হয়।”
মির্জা মাস্টার মাথা ঘুরিয়ে মানুষের ভিড়ের দিকে তাকালেন, ছোট ছোট বাচ্চারা যারা ছোটাছুটি করছে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে এরা সব আমার ছাত্র। ঐ যে বাদাম বিক্রি করছে ছেলেটা আমার একেবারে একনম্বর ছাত্র। অ্যালজেবরা শুরু করেছে। ঐ যে দূরে দুইজন কুস্তি করছে ঐ দুজনও আমার ছাত্র। স্কুল উড়ে গেছে আর পড়তে হবে না, তাদের মনে বড় আনন্দ!”
মির্জা মাস্টার মুখ হা করে খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি খোঁজ পেয়েছি যে আপনারা একটা স্কুল তৈরি করছেন। তাই ভাবছিলাম আমার ছাত্রদের জন্যে যদি একটা ঘর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন তো দেখি স্কুলঘর আপনারা দাঁড়া করেছেন উলটো। স্কুলের মেঝে আকাশে উঠে গেছে, দরজা-জানালা আড়াআড়ি, এই স্কুলে ছাত্র ঢুকবে কোন দিক দিয়ে আর মাস্টার ঢুকবে কোন দিক দিয়ে?”
হারুন ইঞ্জিনিয়ার গলা উঁচিয়ে বললেন, “ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কিসের?”
“ছোটখাটো?” মির্জা মাস্টার তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে যথাসাধ্য বড় করার চেষ্টা করে বললেন, “ছোটখাটো একটা আস্ত স্কুল উলটা করে দাঁড় করেছেন সেটা ছোটখাটো?”
“অবশ্যি ছোটখাটো। একরাত্রে স্কুল উলটো করে দাঁড় করানো হয়েছে, আরেক রাত্রে স্কুল খুলে সোজা করা হবে।”
মির্জা মাস্টার খানিকক্ষণ হারুন ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এক রাত্রে?”
অবশ্যি এক রাত্রে! ভাবছেন কী আপনি? এটা আমার আবিষ্কার করা প্রসেস। আমেরিকা জার্মানি আর জাপানে এটার পেটেন্ট আছে! স্কুলঘরের দায়িত্ব আমি নিয়েছি, আমি ঠিক করে দেব-আপনি আপনার ছাত্রছাত্রী নিয়ে মাথা ঘামান।”
মির্জা মাস্টার তখন ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতের দিকে তাকালেন, ইতস্তত করে বললেন, “কী মনে হয় আপনাদের? স্কুলঘরটা যখন শোওয়ানো হবে তখন কি একটা ঘর পাওয়া যাবে আমার ছাত্রছাত্রীর জন্যে”
ফারুখ বখত বললেন, “আপনি এটা কী বলছেন?”
মির্জা মাস্টার থতমত খেয়ে বললেন, “না মানে ভাবলাম এত বড় একটা স্কুল তার একটা ছোট ঘর যদি দিতেন। কিন্তু আপনাদের যদি অসুবিধে হয় তা হলে থাক–”
ফারুখ বখত মেঘস্বরে বললেন, “না-না-না, আমি মোটেও সেটা বলছি না। আমি বলছি আপনি শুধু একটা ঘর কেন চাইছেন, এই পুরো স্কুল আমরা দিয়ে দেব আপনার ছাত্রছাত্রীদের
“পু-পু-পুরো স্কুল?”
“পুরো স্কুল। ফারুখ বখত ফরাসত আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, দিয়ে দেব না পুরো স্কুল?”
ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “অবশ্যই পুরো স্কুল দিয়ে দেব। স্কুলঘর শেষ হবার আগেই আমাদের ছাত্র খুঁজে বের করার কথা ছিল, এখন আমাদের আর ছাত্র খুঁজে বের করতে হবে না। না চাইতেই পেয়ে গেলাম।” ফরাসত আলি আনন্দে দাঁত বের করে হাসলেন, সাধারণত তিনি হাসলে দাড়িগোঁফের আড়ালে তার দাঁত ঢেকে থাকে, এবারে ঢেকে থাকল না, বেশ খানিকটা বের হয়ে গেল।
মির্জা মাস্টারের ছোট ছোট চোখগুলি গোল হয়ে গেল, খানিকক্ষণ তিনি কথা বলতে পারলেন না, বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বললেন, “পু-পু পুরো স্কুলটা আমার ছাত্রছাত্রীর জন্যে দিয়ে দেবেন? আমার এইসব গরিব মিনতি মুটে ছাত্রদের? কাজের ছেলে, টোকাইদের?”