অনেকে তখন এই মানুষটার সাথে মাথা নাড়ল, একজন বলল, মিয়া ভাই কথাটা মিছা বলে নাই।
বিজলী মানুষগুলোর কথা না শোনার ভান করে বাবার দিকে বলল, বাবা বাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।
বাবা নিরাসক্ত চোখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন? তাড়াতাড়িটা কী জন্যে?
আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূর বাবা, যেতে সময় লাগবে।
আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, এই ছেমড়ি, আদব লেহাজ নাই? বড় মানুষেরা কথা বলতেছে তার মাঝে কথা বলিস?
বিজলী মুখ শক্ত করে বলে, আমি আমার বাবার সাথে কথা বলি।
আমিন মোল্লা হুংকার দিল, কত বড় বেয়াদপ, আবার মুখে মুখে কথা?
বিজলী আমিন মোল্লার কথা না শোনার ভান করে বলল, বাবা। বাড়ি চলো।
তুই যা। আমি আসতেছি।
আশ্রয়কেন্দ্রে যাবা না বাবা?
বাবা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, খামোখা দৌড়াদৌড়ি করে কী হবে? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।
কী বলো বাবা?
ঠিকই বলি।
বিজলী প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমাদের স্যার বলেছে অবশ্যই অবশ্যই যেন আশ্রয়কেন্দ্রে যাই।
বাবা কিছু বলার আগেই আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, স্কুলের স্যার! স্কুলের স্যার বেশি জানে? তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কামটা তুমি ঠিক করো নাই। এত বড় মেয়ে আদব লেহাজ নাই, ড্যাং ড্যাং করে স্কুলে যায়? নাউজুবিল্লাহ্!
বাবা কিছু বললেন না, মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমিন মোল্লা তখন গলা উঁচিয়ে বলল, ঠিক আছে তাহলে, সবার সাথে কথা থাকল। কেউ চর ছেড়ে কোথাও যাইবা না। আমি এই চর পানিবন্দী তাবিজ দিয়ে বেন্ধে রাখছি। কারো কোনো ভয় নাই। হায়াৎ মউত আল্লার হাতে।
সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। যার মরণ যেইখানে নাও বাইয়া যায় সেইখানে! যদি এই চরে আমার মউৎ থাকে তাহলে কি এখান থেকে আমি বের হতে পারুম। পারুম না।
আমিন মোল্লা ধমক দিয়ে বলল, কী সব মরণের কথা বলো! মরবা কেন? কেউ মরবে না।
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না। কেউ মরব না।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যখন বিজলী ফিরে আসছে তখন দেখল আমিন মোল্লার বাড়ির উঠানের বেড়া ধরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। বিজলী একটু এগিয়ে যায়, মহিলাটি আমিন মোল্লার ছোট বউ। বয়স বিজলী থেকে খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না।
বিজলী কাছে যেতেই মহিলাটি ফিস ফিস করে বলল, তুমি তোমার আমিন চাচারে রাজি করাইতে পারো নাই?
কী রাজি করানোর কথা বুঝতে বিজলীর সমস্যা হলো না। মাথা নেড়ে বলল, না।
বউটি মাথা নেড়ে বলল, আমার তুফানরে খুব ভয় করে। অনেক বেশি ভয় করে। আরেকবার বলে দেখো না রাজি করাতে পারো কি না।
বিজলী বলল, লাভ নাই। আমিন চাচা বলছে সে চরের চার কোনায় পানিবন্দী তাবিজ পুঁইতা রাখছে। এই চরে কিছু হবে না।
বউটি শাড়িটি সরিয়ে তার গলায় ঝোলানো অনেকগুলো তাবিজ দেখাল, বলল, সন্তান হয় না দেখে এই দেখো কত তাবিজ দিছে। লাভ হইছে? হয় নাই। তাবিজে কাম হয় না।
বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। বউটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়া মাবুদ। আজ রাতে কী হবে কে বলতে পারে!
বিজলী কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বাড়ি চল বিজলীবু। শীত করে।
বিজলী বলল, চল যাই। বিজলী বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছনের দিকে তাকালো। বউটি তখনো উঠানের বেড়া ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
*
সন্ধ্যেবেলা থেকে ঝড়ের বেগ বাড়তে লাগল। প্রথম দিকে এটা দমকা হাওয়ার মতো ছিল, আস্তে আস্তে সেটা সত্যিকার ঝড় হয়ে গেল। বাতাসটা পুব দিক থেকে পশ্চিমে বইছে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়। নিশ্চয়ই আজ পূর্ণিমার রাত, আকাশের মেঘ ফুটে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে কেমন যেন একটা অপার্থিব আলো। সেই আলোতে সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব স্বপ্নের মতো দেখায়। বাতাসের একধরনের শব্দ শোনা যায়, শিস দেওয়ার মতো শব্দ। শব্দটা কোথা থেকে আসে কে জানে। সেই শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে সমুদ্রের গর্জন শোনা যেতে থাকে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বাতাসের প্রচণ্ড আঘাতে গাছগুলো কেমন যেন মাথা কুটছে। বাড়ির সামনে নারকেলগাছের পাতাগুলো ঝাঁপটে পড়ছে, পুরো গাছটাই মাঝে মাঝে নুইয়ে পড়ছে। বিজলীদের বাড়িটা বাতাসে থরথর করে কেঁপে উঠছে, মনে হয় যেকোনো সময় বুঝি উড়ে যাবে।
যত সময় যেতে থাকে ঝড় তত বাড়তে থাকে। বাতাসের শিস দেওয়ার মতো শব্দ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সবকিছু ছাপিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। গোয়ালঘর থেকে তাদের কালো গাইয়ের ডাক শোনা যেতে থাকে, ভয় পেয়ে কেমন জানি ডাকছে। অবলা পশুটি কেমন করে জানি বিপদটুকু টের পেয়েছে।
বাবা ঘরের মাঝখানে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সামনে একটা কুপি বাতি জ্বলছে, বাতির শিখাঁটি বাতাসের ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতে থাকে। বাবাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে। মা ঘরের ভেতর ছটফট করছিলেন, প্রত্যেকবার বাতাসের ঝাঁপটায় যখন বাড়িটা থর থর করে কেঁপে উঠতে থাকে মা উপরের দিকে তাকান তারপর শুকনো মুখে বলেন, হায় খোদা! হায় পরওয়ার দিগার। হায় মাবুদ। হায় মাবুদ।
খোকন বিজলীকে ধরে রাখছে, বিজলী বুঝতে পারে খোকন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সেও খোকনকে শক্ত করে ধরে রাখে, তাকে নিচু গলায় একটু পরে পরে বলে, ভয় নাই। কোনো ভয় নাই খোকন।