স্যার সাইক্লোন নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। বিজলী কিছু শুনল কিছু শুনল না। কিছু বুঝল কিছু বুঝল না।
ক্লাসের ঘণ্টা বাজার আগেই স্যার ছুটি দিয়ে দিলেন। অন্যদিনের মতো চিৎকার করতে করতে ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে বের হলো না। সবাই চাপা স্বরে নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে প্রায় নিঃশব্দে ক্লাসঘর থেকে বের হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিল। বিজলী একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটার রং কেমন যেন ছাই বর্ণের। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালো, এমনিতে নীলচে সবুজ রঙের সমুদ্রটা এখন কেমন যেন কালচে হয়ে আছে–দেখে মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি রাগ হয়ে আছে। দূর থেকেই বোঝা যায় ঢেউগুলো অনেক উঁচু।
বিজলী বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাস্তাঘাটে মানুষজন খুব বেশি নেই, যারা আছে তারাও নিঃশব্দে তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছে। বিজলী শুনতে পেল একটা রিকশার মাঝে মাইক লাগিয়ে কেউ একজন কিছু বলতে বলতে যাচ্ছে। লোকটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, বিজলী তাই তার কথাটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। মানুষটি বলছে :
সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।
সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।
সবাইকে জানানো যাইতেছে যে অদ্য রাত্রি তিন ঘটিকার সময় ঘূর্ণিঝড় যারিনা উপকূলে আঘাত হানিবে। জলোচ্ছ্বাসের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্য সবাইকে মধ্যরাত্রি বারোটার ভিতরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে। সবাইকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে।
একই কথা বলতে বলতে রিকশাটি দূরে চলে গেল। এখন দুপুর বারোটা, রাত বারোটা হতে এখনো হাতে বারো ঘণ্টা সময়। সবাইকে নিয়ে এর মাঝে সাইক্লোন শেল্টারে চলে আসতে পারবে। বিজলী পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।
বিজলী যখন বাড়ি পৌঁছেছে তখন সে ভিজে চুপসে গেছে। এখনো পুরো জোয়ার আসেনি কিন্তু নিচু জায়গাটা এর মাঝে তলিয়ে গেছে, বুক পানিতে তাকে হেঁটে আসতে হয়েছে। মাঝামাঝি আসতে আসতে ঝির ঝির বৃষ্টিটা ঝম ঝম বৃষ্টিতে পাল্টে গেছে। বাড়ি এসেই সে খোকনের খোঁজ নিল, খোকনও স্কুল থেকে সকাল সকাল চলে এসেছে। তাদের স্কুলে ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি, তাই স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
বাবা বাড়ি নেই, বিজলী মাকে পাকঘরে দেখতে পেল। চুলোয় কয়টা ভেজা কাঠ দিয়ে ধোঁয়ার মাঝে বসে আছেন। বিজলী তার ভেজা কাপড় না পাল্টেই বলল, মা, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।
কই যেতে হবে?
সাইক্লোন শেল্টারে।
মা অবাক হয়ে বললেন, সেটা কী?
সাইক্লোনের সময় সেখানে থাকতে হয়।
কেন?
যখন পানি উঠে আসবে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেজন্যে তখন সাইক্লোন শেল্টার–মানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়।
মা সমুদ্রের মানুষ না, এইসব জানেন না, একটু অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিজলী বলল, সব জায়গায় মাইক দিয়ে বলতেছে। সাত নম্বর মহাবিপদ সংকেত দিছে। আমাদের যাইতে হবে।
মা কেমন করে জানি তাকিয়ে রইলেন, মনে হয় বিজলীর কথা বুঝতে পারলেন না। চুলার মাঝে লাকড়িগুলো ঠেসে দিতে দিতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি এইসব জানি না, তোর বাবারে বল।
বিজলী জিজ্ঞেস করল, বাবা কই?
জানি না। মনে হয় তোর আমিন চাচার বাড়ি।
আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার কোনো ইচ্ছা নাই কিন্তু বিষয়টা অনেকই জরুরি। তাই সে রওনা দিল, বের হওয়ার সময় বিজলী খোকনকে সাথে নিয়ে নেয়। একা একা আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার সাহস নাই।
বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলী আর খোকন দুজনে ভিজতে ভিজতে হেঁটে যেতে থাকে। আমিন মোল্লার বাড়িতে গিয়ে মনে হলো সেখানে অনেক লোকজন।
বাইরের ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গ্রামের বড় মানুষ সবাই গাদাগাদি করে বসে আছে। সবাই মিলে কথা বলছিল, বিজলীকে দেখে সবাই চুপ করে গেল। বাবা বিজলীর দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। কথা বলল আমিন মোল্লা, অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে বলল, কী চাও?
বিজলী বলল, বাবার সাথে কথা বলতে আসছি। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা বাড়ি চল।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
কথা আছে বাবা, জরুরি কথা।
কী কথা?
মাইকে সবাইরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতে বলছে। আজ রাতে সাইক্লোন আসবে।
ঘরের সবাই তখন এক সাথে কথা বলতে থাকে, আমিন মোল্লা তখন ধমক দিয়ে বলল, চোপ।
সবাই তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা বলল, আমার কথার উপর তোমাগো বিশ্বাস নাই?
একজন বলল, তা আছে, কিন্তু—
কিন্তু কী?
এই তুফান তো মারাত্মক। তুফানের সাথে পানি আসে, শুনছি লাখ লাখ লোক মারা যায়।
লাখ লাখ লোক কী মুখের কথা? আমিন মোল্লা বলল, তোমাদের আমি বলছি কি না যে আমি চাইরটা পানিবন্দী তাবিজ চরের চাইর কোনায় পুঁইতা আসছি। এই চরের উপর দিয়ে ঝড় যাইব না, এই চরের ওপর পানি আসব না।
একজন বলল, কিন্তু—
কিন্তু কী?
সরকার ঘোষণা দিছে সেইটা এমনি এমনি তো দেয় নাই।
আমিন মোল্লা গর্জন করে উঠল, এমনি এমনিই দিছে, সরকারের কোন কামটা ঠিক? সব বেঠিক। সব বেদাত।
একজন হঠাৎ করে আমিন মোল্লার পক্ষে কথা বলল, ভাইজান কথাটা মিছা বলে নাই। মনে নাই গেল বছর ঘোষণা দিল তুফান আসব পানি আসব, আমরা গিয়া সারারাত কেন্দ্রের ছাদে বৃষ্টির মাঝে বইসা থাকলাম। কিছুই হইল না, বাড়ি আইসা দেখি আমার গরুটা চুরি কইরা নিছে!