তাদের ছোট বাড়িতে পাকঘর ছাড়া মাত্র দুটি ঘর। একটা ঘরে বাবা-মা ঘুমায়, অন্য ঘরে ছোট একটা বিছানায় বিজলী খোকনকে নিয়ে ঘুমায়। বিছানায় শুয়েই খোকন ফিসফিস করে বলে, বিজলীবু, একটা গল্প বলো।
খোকন যখন তার কাছে গল্প শুনতে চায় বিজলী মনে মনে খুশি হয়, কিন্তু সে মিছি মিছি রাগের ভঙ্গি করে বলে, এত রাত হইছে, এখন আবার গল্প কিসের, ঘুমা।
খোকন তখন বিজলীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বলো না একটা গল্প! মাত্র একটা–
বিজলী তখন বলে, একটা কিন্তু! একটার বেশি না।
ঠিক আছে বিজলীবু।
কিসের গল্প শুনবি?
খোকন লাজুক মুখে বলে, আমার গল্প।
বিজলী প্রতি রাতেই খোকনকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। কীভাবে খোকন কখনো দুর্ধর্ষ ডাকাত দলকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধরে ফেলছে কিংবা কীভাবে খোকন একটা ভেলায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অজানা কোনো দ্বীপে গিয়ে হিংস্র বন্য মানুষের সাথে যুদ্ধ করছে, কিংবা একটা রকেট বানিয়ে কীভাবে মহাকাশে গিয়ে ভয়ংকর কোনো প্রাণীর মুখোমুখি হচ্ছে এরকম গল্প। আজকে বিজলী খোকন কীভাবে অনেক বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে ভয়ংকর একটা অস্ত্র আবিষ্কার করেছে এবং সেই অস্ত্র চুরি করার জন্য কীভাবে আমেরিকা থেকে মানুষ এসেছে সেটা নিয়ে গল্প শুরু করল। বিজলীকে ফিস ফিস করে গল্প বলতে হয়, পাশের ঘরে মা যদি শুনতে পান তাহলে খুব বিরক্ত হয়ে বকাবকি শুরু করেন।
গল্প শুনতে শুনতে খোকন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। গল্প শেষ হলে সে বিজলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী একা একা জেগে থাকে। জেগে জেগে সে খোকনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে। মা সারাদিন কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যান। বাবা জেগে থাকেন, জেগে বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলেন। কী বলেন বোঝা যায়। বাবার জন্যে বিজলীর কষ্ট হয় কিন্তু কী করবে সে বুঝতে পারে। রাত জেগে জেগে সে সমুদ্রের গর্জন শোনে।
সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে বিজলী একসময় ঘুমিয়ে যায়।
*
বিজলীদের স্কুল দুপুর বেলাতেই ছুটি হয়ে গেল। কয়দিন থেকেই আবহাওয়া খারাপ, ঝিরঝির করে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। সমুদ্র পাড়ের মানুষ এরকম আবহাওয়া দেখলেই ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়। যতগুলো বড় সাইক্লোন হয়েছে তার আগে সব সময় এরকম খারাপ আবহাওয়া ছিল।
স্কুল ছুটির আগে শ্যামল স্যারের ক্লাস ছিল। শ্যামল স্যার আজকে ক্লাসে কিছু পড়াননি, বেশির ভাগ সময় খুব গম্ভীর মুখে জানালা দিয়ে দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলেন। এক সময় ক্লাসে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই সবাই জানো একটা সাইক্লোন আসছে। সাইক্লোন যারিনা। সাইক্লোনকে সবসময় একটা নাম দেয়, মানুষের নামে নাম। আগে শুধু মেয়েদের নাম দিত–এখন একবার মেয়ের নাম আরেকবার ছেলের নাম। আগেরটা ছেলেদের নামে ছিল তাই এইবারে মেয়েদের নামে। যারিনা।
অন্যদিন হলে কেউ না কেউ সাইক্লোনের এই নাম দেওয়া নিয়ে কিছু না কিছু বলত, আজকে কেউ কিছু বলল না। সবাই শুকনো মুখে বসে রইল। আজকে ক্লাসে ছেলেমেয়ে বেশি নেই। যারা আছে তাদের বেশির ভাগ সাইক্লোনের কথা জানত না। বিজলীও জানত না। সাইক্লোন আসছে শুনে হঠাৎ করে ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল।
স্যার বললেন, গতকাল পর্যন্ত সাইক্লোনটা আরো উত্তর দিকে যাচ্ছিল, আজকে সকালে হঠাৎ করে দক্ষিণে নেমে সোজাসুজি আমাদের দিকে আসছে। স্যার চুপ করলেন আর বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠল।
আজ শেষ রাতের দিকে সাইক্লোনটা এসে আমাদের এলাকায় আঘাত করবে। কাজেই তোমরা এখন সবাই বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে ফেমিলির সবাইকে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে চলে যাবে। সাইক্লোনটা যখন আসবে তখন ভরা জোয়ারের সময়, তার মানে অনেক বড় স্টর্ম সার্জ হতে পারে।
একজন জিজ্ঞেস করল, স্টর্ম সার্জ মানে কী?
স্টর্ম সার্জ মানে হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। পানি ফুলে উঠবে। এই দেশের সাইক্লোনে পানি অনায়াসে ত্রিশ চল্লিশ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মনে রেখো কিছু বোঝার আগে কিন্তু পানি চলে আসবে, কয়েক মিনিটে সবকিছু পানিতে ডুবে যেতে পারে। সাইক্লোনের প্রচণ্ড ঝড়, তার সাথে পানি–এর থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। কাজেই কেউ কোনো রিস্ক নেবে না। আজ রাতে সবাই সাইক্লোন শেল্টারে কাটাবে। সবাই। বুঝেছ?
ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে বিজলীও মাথা নাড়ল।
স্যার বললেন, তোমাদের ফেমিলি যেহেতু সারা জীবন সমুদ্রের তীরে থেকেছে তাই তারা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলো আমার থেকেও ভালো জানে। তারা নিশ্চয়ই তাদের জীবনে অনেক সাইক্লোন দেখেছে, কিন্তু তোমরা ছোট তোমরা দেখো নাই। তাই আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে বলবে অবশ্যই অবশ্যই যেন সাইক্লোন শেল্টারে যায়।
বিজলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার বাবা-মা সমুদ্রের তীরে জীবন কাটায়নি, সাইক্লোন দেখেনি। সাইক্লোন হলে কী করতে হয় জানে না। নদীর পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভেসে যাবার পর এই চরে এসেছে। এই চরের সব মানুষই এরকম। তারা স্থানীয় মানুষ না।
শ্যামল স্যার আবার জানালার কাছে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আবার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সাইক্লোনে বাতাস ঘুরতে থাকে। বিশাল এলাকা নিয়ে সাইক্লোন হয়। সাইক্লোনের বাতাসের বেগ একশ-দেড়শ মাইল হয়ে যেতে পারে। সাইক্লোনের ঠিক মাঝখানে কোনো বাতাস থাকে না, অনেক সময় উপরে মেঘও থাকে না। সেটাকে বলে সাইক্লোনের আই। আমি শুনেছি যে সাইক্লোনের আইয়ের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সবকিছু একেবারে সুনসান নীরব হয়ে যায়। কোনো ঝড়বৃষ্টি কিছু নেই। আইটা পার হওয়ার পর আবার ঝড় শুরু হয়, বাতাস তখন উল্টোদিকে বইতে থাকে…