মা একটুখানি দেখলেন, বিজলী বলল, খোকন সবচেয়ে ভালো রচনা লিখেছে, সেই জন্যে পুরস্কার পেয়েছে। তাই না রে খোকন?
খোকন মাথা নাড়ল। মা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হয়েছে। এখন যা, গরুটারে লইয়া আয়। মুরগির খোপ খুলে দে। কুপি বাতিগুলোতে তেল ভরে আন। আমাকে তো বান্দি পাইছস। সব মহারাজা মহারানীদের সেবা করার জন্য আমার জন্ম হইছে। সংসারের কাজ সব আমার করতে হবে? অন্য সবাই ড্যাং ড্যাং করে খালি গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে বেড়াবি?
মা ক্যাট ক্যাট করে কথা বলতেই থাকলেন। সারাদিন স্কুলে থেকে বাড়ি এসেছে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। বিজলী সহ্য করে যেতে পারবে কিন্তু খোকনের মুখটা শুকিয়ে আছে দেখে বিজলীর মায়া হলো। বিজলী ইতস্তত করে বলল, মা, খোকনের দুপুরে খাওয়া হয় নাই–
মা ছ্যাৎ করে উঠলেন, বললেন, খাওয়া হয় নাই তো খাওয়া দে। চূলার উপরে দেখ ভাত-তরকারি আছে।
বিজলী মাকে আরো কিছু বলার সুযোগ দিল না, ঘরের বেড়ার উপর ঝুলিয়ে রাখা তাকটাতে বইগুলো রেখে খোকনের হাত ধরে পাকঘরে নিয়ে গেল। একটা পিঁড়িতে খোকনকে বসিয়ে তার সামনে একটা টিনের থালাতে ভাত বেড়ে দিল। শুঁটকির একটুখানি তরকারি ভাতের উপর দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি একটুখানি খেয়ে নে।
তুমি খাবা না বিজলীবু?
নাহ্। দুপুরের যেটুকু ভাত তরকারি রয়ে গেছে সেটা দিয়ে দুজনের হবে না, বিজলী তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার খিদা পায় নাই।
খোকনের খাওয়া শেষ হলে বিজলী কলসি থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আয় খোকন।
বিজলীর পিছু পিছু খোকন হেঁটে হেঁটে যায়। চরের মাঝামাঝি নিচু জায়গাটাতে অনেক ঘাস। চরের মানুষেরা এখানে তাদের গরু ছাগল ছেড়ে যায়। বিজলী তাদের কালো গাইটাকে দূর থেকে দেখতে পেল, ঘাস খেতে খেতে মাঝে মাঝে গলা তুলে ডাকছে, মনে হয় বাছুরটাকে খুঁজছে।
বিজলী গরুর খুঁটিটা টেনে তুলে দড়িটা পাকিয়ে ছোট করে নেয়। তাকে আর কিছু করতে হয় না, কালো গাইটা কেমন করে নিজেই জানি বুঝে গেছে এখন বাড়ি যাবার সময় হয়েছে। গাইটা আবার গলা ছেড়ে ডাকল তখন ছোট বাছুরটা অনেকটা লাফাতে লাফাতে হাজির হলো। খোকন বাছুরটাকে একটু আদর করার চেষ্টা করল, বাছুরটা অনেকটা খেলার ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যায়। খোকন তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, দেখছ বিজলীবু বাছুরটা কী করে?
বিজলী বলল, তোর সাথে খেলছে!
আমার সাথে কেন খেলছে বিজলীবু?
তুই তো একটা গরু, বাছুরটাও একটা গরু, সেই জন্যে তোর সাথে খেলে!
খোকন বিজলীকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও! আমি গরু না, তুমি গরু!
বিজলী হাসল, বলল, ঠিক আছে। তুইও গরু, আমিও গরু। বিজলী তখন গরুর মতো করে ডাকল, হাম্বা!
খোকন অকারণেই হি হি করে হাসতে থাকে।
বাড়িতে এসে বিজলী গরু আর বাছুরটাকে গোয়ালঘরে ঢোকাল। বাছুরটাকে আলাদা করে বেঁধে রাখল যেন রাতের বেলা দুধ খেয়ে না ফেলে। মাটির মালসায় তুষের আগুন করে গোয়ালঘরে মশা তাড়ানোর জন্যে ধোয়া দিল। তারপর মোরগের খোঁপটা পরিষ্কার করে নিচে এক প্রস্ত ছাই দিয়ে ঢেকে দিয়ে মুখে কঁক কঁক করে শব্দ করল। মোরগ মুরগিগুলো তখন মাথা তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে এসে একটি একটি করে খোপের ভেতর ঢুকে যায়! একটা মা মুরগি এদিক সেদিক তাকিয়ে তার ছোট ছোট ছানাগুলোকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল।
বিজলী তখন বাইরে নেড়ে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে ভেতরে নেয়, তারপর কুপি বাতিগুলো পরিষ্কার করে তার মাঝে কেরোসিন ঢেলে নেয়। বাতিগুলো সে বারান্দায় সাজিয়ে রাখে আরেকটু অন্ধকার হলে বাতিগুলো জ্বালাবে।
ঘরের কাজ শেষ করে বিজলী খোকনকে নিয়ে সমুদ্রের বালুবেলায় দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্য অস্ত যাবার পর পশ্চিম আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কোনো কোনোদিন আকাশটা বেশি লাল হয়ে থাকে, কোনোদিন কম। তার কারণটা কী কে জানে।
সমুদ্রের ঢেউগুলো একটার পর একটা এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। শ্যামল স্যার মনে হয় ঠিকই বলেছেন, সমুদ্রটা যেন সত্যিই জীবন্ত, প্রত্যেকটা ঢেউ যেন সমুদ্রের একটি একটি করে নিঃশ্বাস। জোয়ার শুরু হয়েছে, দেখতে দেখতে পুরো বালুবেলাটা পানিতে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রের একধরনের গর্জন আছে। কোনো কোনোদিন সমুদ্র শান্ত থাকে, তখন গর্জনটি হয় মৃদু। কোনো কোনোদিন মনে হয় সমুদ্রটি রেগে আছে, তখন সমুদ্রের গর্জনটিও হয় ক্রুদ্ধ গর্জন। আজকে মনে হয় সমুদ্রটি শান্ত, তাই তার গর্জনটার মাঝে একধরনের শান্ত শান্ত ভাব।
বিকেলের বাতাসটি বইতে শুরু করেছে। বাতাসের মাঝে একধরনের লোনা গন্ধ, বিজলী বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিল। খোকন বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে গালে হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই খোকন গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবে। কী ভাবে কে জানে।
দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে, বাড়ি যেতে হবে। একটু দেরি হলেই মা বকাবকি শুরু করবেন। বিজলী বলল, খোকন, আয় বাড়ি যাই।
খোকন উঠে দাঁড়াল, তারপর বিজলীর হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
.
রাত্রি বেলা বেশ তাড়াতাড়ি বিজলী খোকনকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রতি রাতেই তাই হয়, রাত জেগে থাকলেই কুপি বাতি জ্বালাতে হয়, কুপি বাতি জ্বালালেই বাড়তি কেরোসিনের খরচ, তাই তাদের সকাল সকাল ঘুমিয়ে যেতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও রাত জেগে বিজলী লেখাপড়া করতে পারে না।