.
খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল, বলল, খোকন, উঠ, এখনো অনেকদূর যাইতে হবে। দেরি হলে মা বকবে।
খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি না হলেও মা বকবে।
।বিজলী কিছু বলল না, খোকন ভুল বলেনি। মায়ের বকুনি খেতে খেতে এত দিনে বিজলীর অভ্যাস হয়ে যাবার কথা, কিন্তু কেন জানি বিজলীর অভ্যাস হয়নি। প্রত্যেকবার সে যখন মায়ের বকুনি খায় তার
মনটা খারাপ হয়ে যায়।
*
বাড়ি পৌঁছানোর পর মায়ের বকুনি খাওয়ার কথা, আজকে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই বিজলী বকুনী খেলো। বকুনি দিল আমিন মোল্লা।
বিজলী আর খোকন যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসছে তখন আমিন মোল্লা তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে লম্বা আলখাল্লা। মাথায় টুপি আর চোখে সুরমা, মুখে লম্বা দাড়ি। গালে একটা কাটা দাগ, লম্বা দাড়ি দিয়েও সেই কাটা দাগ ঢেকে রাখা যায় না। কীভাবে আমিন মোল্লার গাল কেটেছে কে জানে, তাকে কেউ সেটা কখনো জিজ্ঞেস করেনি। বিজলীর ধারণা আমিন মোল্লা এই চরে আসার আগে ডাকাত ছিল, ডাকাতদের এরকম গাল কাটা থাকে। খুন জখম করে পালিয়ে এসে এখানে মোল্লা সেজে লুকিয়ে আছে। মানুষটাকে দেখলেই বিজলীর বুকটা কেমন জানি কেঁপে ওঠে।
আমিন মোল্লার দুজন বউ কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে নাই। বিজলী অনুমান করতে পারে যদি ছেলেমেয়ে না হয় তাহলে কয়েক দিন পর সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে।
আমিন মোল্লা আরো একটা কেন আরো বেশি বিয়ে করতে চাইলে করে ফেলুক, তাতে বিজলীর কিছু এসে যাওয়ার কথা না। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিটা দেখলেই তার বুকটা কেমন জানি হিম হয়ে যায়। আজকেও যখন খোকন আর বিজলী হেঁটে হেঁটে আসছিল তখন আমিন মোল্লা তার সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে বিজলীর দিকে তাকালো, কালো
জিব বের করে ঠোঁট চেটে বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, কই থেকে আসতাছস?
খোকন আর বিজলী দুজনের হাতেই বই খাতা, কাজেই তারা যে স্কুল থেকে আসছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। তারপরও বিজলী বলল, স্কুল থেকে।
স্কুল? আমিন মোল্লা এমন ভঙ্গি করল যেন স্কুল অত্যন্ত কুৎসিত নোংরা একটা জায়গা।
বিজলী মাথা নাড়ল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে বলল, তোর বাপের এত বড় সাহস, এত বড় বেগানা মেয়েরে স্কুলে পাঠায়?
বিজলী ভেবেছিল সে চুপ করে এই মানুষটার কথা সহ্য করে যাবে, কিন্তু হঠাৎ কী হলো কে জানে সে জিজ্ঞেস করে বসল? কেন? স্কুলে গেলে কী হয়?
আমিন মোল্লা হঠাৎ খেপে গেল, মুখ খিঁচিয়ে বলল, কী? তোর এত বড় সাহস? আমার মুখের উপর কথা?
বিজলী তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে দাঁত বের করে মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি দেখুম, কেমন করে এই কাজলডাঙ্গা চরের মেয়ে হয়ে তুই স্কুলে যাস। এই কাজলডাঙ্গায় বেপর্দা বেগানা মেয়েছেলের জায়গা নাই। তোর বাপ মনে করে কী? তুই বড় হয়ে জজ বেরিস্টার হবি? শুনে রাখ, মেয়েলোকের জায়গা একটাই সেইটা হচ্ছে স্বামীর ঘর। আদব লেহাজ নিয়ে স্বামীর সেবা করা ছাড়া মেয়েলোকের আর কুনো কাম নাই।
বিজলী কেমন যেন অবাক হয়ে এই ভয়ংকর মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বিজলীবু! চলো, যাই।
বিজলী তখন আর কোনো কথা না বলে খোকনের হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে। হেঁটে যেতে যেতে টের পেল আমিন মোল্লা পেছন থেকে তার চোখ দিয়ে তাকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে।
বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মা চিৎকার করতে শুরু করলেন, এতক্ষণে বেগম সাহেবের বাড়ি ফিরে আসার সময় হলো? বেগম সাহেব লেখাপড়া করে মহারানী হবেন? খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটার কথা মনে আছে? বাড়ির মানুষজন যে চিন্তা করতে পারে একবার সেই কথাটা মনে হইছে? মনে হইছে একবার?
বিজলী চুপ করে রইল। খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটা বিজলী জেনেছে বিকেল বেলা, তার কী করার আছে? একটা প্রাইজ পেয়ে বেচারা খুশি হয়েছে, সে জানে বাড়ির আর কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সেই জন্যে সে বিজলীর কাছে তার স্কুলে চলে গিয়েছে, সেইটা সে কেমন করে তার মাকে বোঝাবে? তাছাড়া সেজন্য বাড়ির মানুষজন যে খুব চিন্তা করেছে সেইটাও তো মনে হয় না। বাবা চুপচাপ বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তারা দুজন যে বাড়ি এসেছে, সেইটা মনে হয় দেখেন পর্যন্ত নাই।
মা আরেকবার এক পশলা গালি দেওয়ার জন্যে মুখ খুলছিলেন তখন বিজলী বলল, মা, খোকন একটা প্রাইজ পেয়েছে।
মা ভুরু কোঁচকালেন, কী পেয়েছে?
প্রাইজ। ফাস্ট প্রাইজ।
মা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হলো ঠিক বুঝতে পারছেন খবরটা শুনে খুশি হবেন নাকি রাগ হবেন। তার গালাগাল করার স্রোতটা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে হয় একটু রেগেই উঠলেন, রাগটাকে কোনোরকমে চেপে রেখে বললেন, কী প্রাইজ?
বিজলী বলল, একটা বই। কী সুন্দর একটা বই। বিজলী খোকনকে বলল, খোকন, দেখা। তোর বইটা দেখা।
খোকন তার হাতের বইগুলোর ভেতর থেকে ছোটদের মহাপুরুষ বইটা বের করে আনল। বাবা কিংবা মা কেউই বইটা হাতে নিয়ে দেখার উৎসাহ দেখাল না। অপ্রস্তুত বিজলী তখন নিজেই বইটা হাতে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিল, বাবা খুবই অনিচ্ছার সাথে বইটা হাতে নিলেন, একটু উল্টেপাল্টে দেখলেন, কিন্তু খুলে ভেতরে দেখলেন না। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বইটা বিজলীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন। বিজলী বইটা হাতে নিয়ে খুলে ভেতরের ছবিগুলো বের করে মাকে দেখানোর চেষ্টা করল, বলল, দেখো মা, কী সুন্দর ছবি।