রায়হান কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। মিলি বলল, ইদরিসকে ফোন করো। ইদরিস জানে মেয়েটা কোন গার্মেন্টসে কাজ করে। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। উঠো তাড়াতাড়ি।
রায়হান বিছানা থেকে উঠল।
.
বিজলী ঘরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে। অনেক রাত হয়েছে। সে ঘুমাতে পারছে না। ঘুমানোর চেষ্টাও করেনি, চুপচাপ বসে আছে। সে এখন কী করবে? খোকন যদি তাকে চিনতে না পারে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে? কী নিয়ে সে বেঁচে থাকবে! দিনের পর দিন সে পথেঘাটে বেঁচে থেকেছে শুধু একদিন খোকনের সাথে দেখা হবে সেই আশায়। এখন যদি সেই আশাটাও না থাকে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে?
তার এই ছোট অ্যাপার্টমেন্টটা বড় রাস্তার পাশে। সারাদিন গাড়ি বাস টেম্পোর শব্দ শুনতে পায়। রাত হলে ভারী ট্রাকের গর্জন শুনে। এখন কোনো শব্দ নেই। সবাই তার কাজ শেষ করে ঘুমুতে গেছে। শুধু বিজলীর চোখে ঘুম নেই। সাইক্লোনের রাতে গাছের ডালে বসে সে যেরকম সারারাত ছটফট করেছে, আজকেও সে সেরকম ছটফট করছে। শুধু এখন সাথে খোকন নেই।
বিজলী একটা গাড়ির শব্দ শুনল। মনে হলো তার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা থেমেছে। এত রাতে কে এসেছে? তার মতো আজ রাতে আর কার চোখে ঘুম নেই?
কেউ একজন নিচে দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। মনে হলো বিল্ডিংয়ে কয়েকজন এসে ঢুকল। বিজলী সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পায়ের শব্দ তার দরজার সামনে এসে থেমে গেল। তারপর কেউ একজন তার দরজায় শব্দ করল। টুক টুক টুক।
বিজলী উঠে দাঁড়াল, ঘরের আলো জ্বালিয়ে সে দরজাটি খুলে দিল। বাইরে খোকন দাঁড়িয়ে আছে। তার খোকন। খোকনের হাত ধরে তার নতুন মা। পেছনে মনে হয় আরো কয়েকজন, বিজলী তাদের দেখল না।
খোকনের হাত ধরে রাখা তার নতুন মা নরম গলায় বলল, বিজলী মা। তোমার ছোট ভাইকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।
বিজলী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের দরজায় আবছা অন্ধকার, খোকনের চেহারাটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বিজলী তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খোকন এসে বিজলীর হাতটা ধরল, বিজলী টের পেল খোকন সেই হাতটা শক্ত করে ধরেছে যেন আর কোনোদিন ছুটে না যায়। বিজলী তখন খুব ধীরে ধীরে খোকনকে নিজের কাছে টেনে আনে, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে। খোকনের মাথার চুলের মাঝে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিয়ে বিজলী ডুকরে কেঁদে উঠল। কতদিন সে এভাবে কাঁদেনি।
মিলি, রায়হান, আফজাল সাহেব, ইদরিস ড্রাইভার এবং বিল্ডিংয়ের দারোয়ান দেখতে পেল দুটি ভাইবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।
কেউ তাদের থামানোর চেষ্টা করল না। কাঁদুক। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদুক।
যতক্ষণ ইচ্ছা কাঁদুক।
*
দরজা খুলে রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?
নাজনীন তার ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। রায়হানকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আরে! রায়হান সাহেব, কোনো খবর না দিয়ে চলে এসেছেন? আসেন আসেন।
রায়হান ভেতরে ঢুকল, বলল, খবর না দিয়ে এসেছি, কিন্তু খবর না নিয়ে আসিনি। আমার সাথে আরো অনেকে আছে!
নাজনীনকে কেমন জানি ভীত দেখাল। ইতস্তত করে বলল, কোথায়?
আসছে। সবাই আসছে।
প্রথমে খোকনের হাত ধরে মিলি ভেতরে ঢুকল। তারপর বিজলীর হাত ধরে সেলিনা জাহান। তাদের পেছনে আফজাল সাহেব।
নাজনীন সবার দিকে একবার তাকালো এবং মুহূর্তের মাঝে সবকিছু বুঝে গেল।
সেলিনা জাহান একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি সকালের ফ্লাইটে এসেছি, বিকালের ফ্লাইটে চলে যাব।
নাজনীন কিছু বলল না। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছি জানেন?
নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কিছু একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। ইনফরমেশন গ্যাপ–
সেলিনা জাহান আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, না। কোনো মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি। কোনো ইনফরমেশন গ্যাপ নেই। সবকিছু আপনার পরিকল্পনামতো হয়েছিল, শুধু আপনি বিজলীকে চিনতে পারেননি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে আপনি আন্ডারএস্টিমেট করেছেন। এই বাচ্চা মেয়েটা সাইক্লোনের রাতে টাইডাল ওয়েভের মাঝে তার ভাইটিকে ধরে রেখেছিল। ছুটে যেতে দেয়নি। কিন্তু আপনি সেই ভাইটিকে ছুটিয়ে আলাদা করে এই মেয়েটাকে পথে বের করে দিয়েছেন। মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, মেয়েটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। সেলিনা জাহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তাই আমরা আপনাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি।
নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কী কথা?
আপনি আসলে মানুষ না। আপনি রাক্ষুসী। আপনার মানুষের সাথে থাকার কথা না। আপনার অন্য রাক্ষস অন্য রাক্ষুসীর সাথে থাকার কথা। আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব। খোদার কসম।
নাজনীনের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়, সে কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না, মাথা নিচু করে ফেলে।
মিলি খোকনের হাত ধরে রেখে বলল, চল, আমরা যাই। এখানে আমি এক সেকেন্ডও থাকতে পারব না।
খোকন বলল, হ্যাঁ। চল।
আমাদের আজকে অনেক প্রোগ্রাম। নতুন বইয়ের দোকানটা আমাদের এখনো দেখা হয়নি, মনে আছে? এসো বিজলী।
যেভাবে সবাই ঢুকেছিল, সবাই সেভাবে বের হয়ে গেল। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিজলী দাঁড়িয়ে গেল। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কী হলো?
এক সেকেন্ড। আমি নাজনীন ম্যাডামকে একটা জিনিস বলে আসি।