খোকন মেয়েটিকে চিনতে পারছে না।
নাজনীন বুকের ভেতর আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে বলল, খোকন যদি চিনতে না পারে তাহলে সে কেমন করে তার বোন হতে পারে? এই মেয়ে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের ক্রিমিনাল–আপনাদের ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে। কোনো পাত্তা দেবেন না। থানায় একটা জিডি করে রাখেন।
মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু মেয়েটা এত ইমোশনাল হয়ে গেল, কথাবার্তা এত রিয়েলিস্টিক যে আমার কাছে মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি তার আপন বোন। আমি খুবই আপসেট।
নাজনীন হা হা করে হাসল, বলল, না, না, মোটেও আপসেট হবেন না। আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। খোকনের কোনো ভাইবোন নেই, আপনি চাইলে আমি আমাদের রেকর্ড দেখাতে পারি।
মিলি বলল, না, না। আপনাকে রেকর্ড দেখাতে হবে না। আপনি বললেই আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু মেয়েটি এমনভাবে কথা বলছিল যে আমার মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি খোকনের বোন।
না না, মোটেও না। নাজনীন জোর দিয়ে বলল, মোটেও খোকনের বোন না। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাদের শেল্টারে ছিল, খোকনের সাথে পরিচয় করে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে–এখন আপনাদের সামনে ভাণ করছে সে খোকনের সবকিছু জানে! একধরনের ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা। একেবারে পাত্তা দেবেন না। আপনি বরং আমাকে বলেন মেয়েটা কোথায়। আমি পুলিশকে জানিয়ে রাখতে পারি, পুলিশে আমার পরিচিত মানুষ আছে। দেখামাত্র অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
মিলি অন্যমনস্কের মতো বলল, না। অ্যারেস্ট করাতে হবে না। বাচ্চা একটা মেয়েকে অ্যারেস্ট করাব কেন?
.
রায়হান অফিস থেকে আসার পর মিলি আর রায়হান মিলে খোকনকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করল কিন্তু খোকন উঠতে রাজি হলো না। বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে রইল। মিলি অবাক হয়ে দেখল একটু পরে পরে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিলি অনেকক্ষণ তার মাথায় শরীরে হাত বুলাতে লাগল কিন্তু খোকন কাঁপতেই থাকল। রাত্রে খোকন কিছু খেলো না।
খোকন অস্থির অনুভব করে। দুপুরবেলা স্কুলে যে মেয়েটাকে দেখেছে কিছুতেই সেই মেয়েটার কথা ভুলতে পারছে না। সে মেয়েটাকে চিনে না, কিন্তু কী আশ্চর্য, তবু তার মনে হচ্ছে সে মেয়েটাকে আগে দেখেছে। মনে হচ্ছে তার খুব কাছাকাছি মেয়ে। মেয়েটা সাইক্লোনের কথা বলছিল, খোকন সত্যি সত্যি মনে করতে পারে সে একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলেছিল, সাথে আর কেউ ছিল কি না সেটা তার মনে নেই কিন্তু এখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ছে যে তখন আরো কেউ তার সাথে ছিল। বিজলী নামটা খুবই পরিচিত একটা নাম, কিন্তু যতবার এই নামটা মনে করতে চায় ততবারই মনে হয় খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যাবে। কেউ একজন কাউকে খুন করে ফেলবে। কে কাকে খুন করবে? কেন খুন করবে?
খোকন কিছু মনে করতে পারে না, অস্থির হয়ে সে ছটফট করতে থাকে।
মিলি অনেক রাত পর্যন্ত খোকনের মাথার কাছে বসে রইল, একসময় মনে হলো খোকন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে নিঃশব্দে উঠে নিজের বিছানায় শুতে গেল। মিলি একা একা বিছানায় শুয়ে রইল, সে কিছুতেই বিজলী নামের সেই বিচিত্র মেয়েটার কথা ভুলতে পারছিল না। মেয়েটার কথাবার্তার মাঝে কিছু একটা ছিল যেটা চট করে ভুলে যাওয়া যায় না। মিলি বিছানায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে যায়। কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে ঝট করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর বিছানা থেকে নেমে সে দ্রুত পায়ে খোকনের ঘরে গেল। খোকন তার বিছানায় বসে আছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মিলি মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে খোকনের মাথায় হাত রাখল, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা?
খোকন মিলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার সব মনে পড়েছে মা।
কী মনে পড়েছে।
বিজলীবুয়ের কথা।
মিলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, বিজলী তোমার বোন?
হ্যাঁ।
তাহলে কোনোদিন বিজলীর কথা বললে না কেন?
ম্যাডাম বলেছিল বিজলীবুয়ের কথা বললে তাকে খুন করে ফেলবে।
কোন ম্যাডাম বলেছিল?
নাজনীন ম্যাডাম। সেই জন্যে আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে কিছু বলি নাই। তারপরে কীভাবে জানি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। বিজলীবুয়ের কথা বললেই মাথার ভেতর কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে যেত। মনে করতে পারতাম না।
মিলি নিঃশব্দে খোকনের মাথায় হাত বুলাল।
খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বিজলীবুকে নাজনীন ম্যাডাম খুন করতে পারে নাই। বিজলীবু বেঁচে আছে–
হ্যাঁ বেঁচে আছে।
কিন্তু বিজলীবুকে তো আর খুঁজে পাব না। কোনোদিন খুঁজে পাব না! খোকন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
মিলি বলল, কে বলেছে খুঁজে পাব না। একশবার খুঁজে পাব।
খোকন কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকালো, তুমি বিজলীবুকে খুঁজে বের করতে পারবে?
হ্যাঁ।
কখন?
এখন।
এখন?
হ্যাঁ। তুমি জামা কাপড় পর, আমরা এখনই বিজলীকে খুঁজতে বের হব।
মিলি শোয়ার ঘরে গিয়ে রায়হানকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল। রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
উঠো।
কেন?
বিজলীকে খুঁজে বের করতে হবে?
কাকে?
মিলি বলল, বিজলীকে।
কেন?
খোকনের সবকিছু মনে পড়েছে। বিজলী আসলেই তার বোন।
রায়হান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, কিন্তু এত রাতেই কেন খুঁজে বের করতে হবে?
মিলি ড্রয়ার খুলে তার একটা শাড়ি বের করতে করতে বলল, তার কারণ আমি এই বাচ্চা মেয়েটার উপর অনেক বড় অবিচার করেছি। আমার তাকে খুঁজে বের করে তার হাত ধরে মাফ চাইতে হবে।