বিজলীর মাথাটা ঘুরে উঠল, এত কষ্ট করে সে খোকনকে খুঁজে বের করেছে এখন তার সাথে সে একবার কথাও বলতে পারবে না? হঠাৎ করে বিজলীর শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে, সে কঠিন গলায় বলল, আমি যাব না। আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলব।
ঠিক তখন স্কুলের ভেতর ছুটির ঘণ্টা পড়ল এবং স্কুলের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে গেট দিয়ে বের হতে থাকল। বিজলী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তীক্ষ্ণ চোখে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ করে খোকনকে দেখা গেল, সে এদিক-সেদিক তাকাল, তার নীল গাড়িটা চোখে পড়ল, তখন রাস্তা পার হয়ে খোকন গাড়িটার দিকে ছুটে আসতে থাকল। বিজলীও ছুটে গেল, খোকনকে মাঝপথে
আটকে সে চিৎকার করে ডাকল, খোকন!
খোকন ঘুরে তাকালো, বিজলীকে এক নজর দেখল, তাকে চিনতে পারল না। বিজলীকে পাশ কাটিয়ে সে তার মায়ের দিকে ছুটে যেতে থাকে। বিজলী হকচকিত হয়ে খোকনের পিছু পিছু ছুটে যেতে যেতে আবার চিৎকার করে ডাকল, খোকন! আমি বিজলী। তোর বিজলীবু।
খোকন আবার বিজলীর দিকে তাকালো, কিন্তু তাকে এবারেও চিনতে পারল না, তার চোখে-মুখে হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে, সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল।
বিজলীর মনে হলো তার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে, সে ভাঙা গলায় বলল, খোকন, সোনা, ভাইটি আমার–তুই আমারে চিনতে পারছস না? আমি বিজলী! তোর বিজলীবু?
খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি তোমাকে চিনি না। তুমি যাও।
বিজলী হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বলল, খোকন! তুই আমারে চিনতে পারছস না? চিনতে পারছস না?
মিলি খোকনকে নিয়ে টেনে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কঠিন গলায় বিজলীকে বলল, আমি তোমাকে বলেছি মেয়ে। খোকন তোমার ভাই না। তুমি তো দেখছ সে তোমাকে চেনে না। এখন এখানে সিন ক্রিয়েট করো না। তুমি যাও! তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদরিস মিয়া গাড়ি চালাও।
বিজলী তখনো হাল ছাড়ল না, ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকন, তোর মনে নাই, তোরে নিয়া সারারাত গাছের উপর বসে থাকলাম? মনে নাই সাইক্লোন এসে আমাদের উড়ায়ে নিচ্ছিল, তুই আর আমি সারারাত গাছ ধইরা ঝুলে রইলাম? তোর মনে নাই বাতাসে গাছের ডাল এসে তোরে আর আমারে চাবুকের মতো মারতে লাগল? মনে নাই?
খোকন কেমন যেন থর থর করে কাঁপতে থাকে, ফিসফিস করে বলল, না, আমার মনে নাই। আমার কিছু মনে নাই। তুমি যাও। প্লিজ। তুমি যাও।
বিজলী ভাঙা গলায় বলল, মনে নাই তুই আর আমি সারাদিন বালুর উপর শুয়ে রইলাম? সেলিনা আপা এসে আমাদের হাসপাতালে নিল? মনে নাই?
খোকন তার মায়ের শরীরে মুখ লাগিয়ে বলল, না, মনে নাই। তুমি যাও। যাও।
মিলি ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বলল, কী হলো? তুমি গাড়ি ছাড়ছ কেন?
ইদরিস ড্রাইভার বলল, মেয়েটা ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে রেখেছে, যেতে পারছি না।
মিলি বিজলীর মাথাটা ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করার চেষ্টা করতে করতে ধমক দিয়ে বলল, কী করছ তুমি? সরে যাও। সরে যাও বলছি।
বিজলী সরে গেল না, চিৎকার করে বলল, খোকন, তোর মনে নাই তুই আর আমি হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম! মনে নাই সমুদ্রের পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম? মনে নাই তুই একবার বই পুরস্কার পাইলি, ছোটদের মহাপুরুষ? মনে নাই?
খোকন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে থর থর করে কাঁপতে থাকে। মিলি ধাক্কা দিয়ে বিজলীকে সরিয়ে দিল এবং সাথে সাথে ইদরিস ড্রাইভার প্যাডেলে চাপ দিয়ে গাড়িটা ছুটিয়ে নিতে থাকে। বিজলী গাড়ির জানালা ধরে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে আছড়ে পড়ল এবং সেইভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
কয়েকজন বিজলীর কাছে ছুটে এসে তাকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে মেয়ে?
বিজলীর চারপাশে মানুষের ভিড় জমে যায়। বিজলী মাথা নেড়ে বলল, না, কিছু হয় নাই। আমার কিছু হয় নাই। আপনারা যান। যান আপনারা।
তারপর ভিড় ঠেলে সে বের হয়ে আসে। তার চারপাশের জগত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে? কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? রাস্তা দিয়ে বিশাল একটা দোতলা বাস আসছে? সে কি এখন ছুটে গিয়ে বাসের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে? পড়বে ঝাঁপিয়ে?
বিজলী ফুটপাথে বসে পড়ে আকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
*
বাসায় এসে খোকন কিছু খায়নি। নিজের ঘরে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। কিছু একটা ঘটছে, কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে।
মিলি খোকনের সামনে কারো সাথে কথা বলেনি। খোকন তার ঘরে ঢুকে যাবার পর প্রথমে রায়হানকে ফোন করে তার সাথে কথা বলেছে। তারপর হ্যাপি চাইল্ডে ফোন করে, নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছে, আপনি কি জানেন, খোকনের কি বিজলী নামে কোনো বোন আছে?
নাজনীন হঠাৎ কেমন জানি বিপদের গন্ধ পেল, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন? কে বিজলীর কথা বলেছে?
আজকে খোকনের স্কুলে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হাজির। পনেরো ষোল বছর বয়স। সে বলছে খোকন তার ছোট ভাই?
তাই নাকি? নাজনীন অবাক হবার ভান করল, খোকন কী বলছে?