বই। এই দেখো কী সুন্দর বই।
স্কুলের ছেলেমেয়েরা বইটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সুন্দর বই। অনেক সুন্দর।
আনন্দের উত্তেজনা কমে যাবার পর বিজলী খোকনকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। স্কুলের রাস্তাটা পার হতেই লোকজন কমে আসে। বিজলী আর খোকন হেঁটে হেঁটে তখন সমুদ্রের কিনারায় যেতে থাকে। শুকনো বালুর উপর দিয়ে হাঁটা যায় না, তাই দুজন ভেজা বালুতে নেমে আসে। সমুদ্রের ঢেউ একটু পরে পরে প্রায় তাদের পা স্পর্শ করতে চলে আসছিল। খালি পায়ে ভেজা বালুতে পা ফেলে ফেলে দুজন হাঁটতে থাকে।
খোকন একটু শান্ত এবং চুপচাপ। খোকনের জন্মের পর মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছিল তখন বিজলীই খোকনকে বেশির ভাগ সময় কোলে নিয়ে বড় করেছে। বিজলী মাঝে মাঝে অবাক হয়ে খোকনকে দেখে, এইটুকুন মানুষ তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন সেই ছোট বাচ্চাটা স্কুলে যায়, রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে বিজলী বলল, আজকে কী হইছে জানিস?
কী হইছে বিজলীবু?
আমাদের একজন নতুন বিজ্ঞান স্যার আসছে। খুবই ভালো স্যার। স্যার কী বলছে জানস?
কী বলছে?
বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।
সেইটার মানে কী?
বিজলী নিজেও সেটার মানে জানে না, তাই আন্দাজ করে বলল, যারা খুব চিন্তা করতে পারে তারা হচ্ছে এনালিটিকেল মাইন্ড।
তুমি খুব বেশি চিন্তা করতে পারো বিজলীবু?
নিশ্চয়ই পারি। আমি স্যারকে একটা প্রশ্ন করছিলাম, স্যার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাই। সেই জন্যে বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।
স্যার তোমার উপরে রাগ হয় নাই।
না। রাগ হয় নাই। রাগ হবে কেন?
আমাদের স্যাররে প্রশ্ন করলে স্যার রাগ হয়।
বিজলী বলল, আমাদের এই স্যার রাগ হয় না।
তুমি কী প্রশ্ন করছিলে বিজলীবু?
বিজলী তখন অনেক ডালপালা লাগিয়ে তার প্রশ্ন করার কাহিনীটা খোকনকে বলল। খোকন পুরোটুকু শুনে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের স্যার মনে হয় ঠিকই বলছে। তোমার অনেক বুদ্ধি, তাই না বিজলীবু।
বিজলী হাসল, বলল, আমি কি বুদ্ধি ধুয়ে পানি খাব? বুদ্ধি দিয়ে কী করব?
মনে নাই একবার একটা বিড়ালের মুখ কৌটার মাঝে আটকে গেছিল, বিড়ালটা ভয় পেয়ে কী করছিল–তখন তুমি বিড়ালটারে ছুটায়ে দিছিলা?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, মনে আছে!
তারপর কাঁঠালগাছটাতে এত বড় একটা বোলতার চাক হইছিল, বোলতার কামড় খেয়ে বাবার মুখটা কেমন ফুলে উঠছিল, মনে আছে?
মনে আছে। বিজলী মাথা নাড়ল।
কেউ কাছে যেতে সাহস পায় না–তুমি তখন ধোয়া দিয়ে বোলতাগুলা সরায়ে বোলতার চাক কেটে ফেললে! মনে আছে?
বিজলী বলল, মনে আছে।
তারপর সেই ঘণ্টার অঙ্কটা? কেউ করতে পারে না, তুমি করে দিলা?
বিজলী হি হি করে হাসল, বলল, ধুর ঐটা তো সোজা অঙ্ক ছিল।
খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না বিজলীবু! ঐটা সোজা অঙ্ক ছিল না, অনেক কঠিন ছিল।
বিজলী কথা না বলে সমুদ্রের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ করে পা ফেলে। হেঁটে যেতে থাকে। খোকন অনেকটা আপন মনে বিজলীর সাথে কথা বলতে থাকে। এমনিতে খোকন খুব বেশি কথা বলে না। আজকে কী হয়েছে কে জানে, সে অনেক কথা বলছে। খোকনের কথা শুনতে শুনতে বিজলী চোখের কোনা দিয়ে মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। তার এই ছোট ভাইটিকে বিজলী খুব আদর করে।
বিজলী যখন ছোট, তখন নদী ভেঙে এক রাতের মাঝে তাদের বাড়িঘর জমিজমা সবকিছু পানিতে ভেসে গিয়েছিল, তখন বাবা জানি কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। কথা বলেন না, নদীর ঘাটে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গ্রামের কিছু লোক তখন বাবাকে বলল, দক্ষিণের এই চরে এসে ঘর বাঁধতে। বাবা তখন সবাইকে নিয়ে এই চরে এসে ঘর বেঁধেছেন। বাবা এখানে এসেও বেশি কথাবার্তা বলেন না, দেখে মনে হয় মাথার কিছু একটা দোষ হয়েছে। বাবা যখন কেমন হয়ে গেছেন তখন বাধ্য হয়ে মা সংসারের অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের শরীর সব সময়ই খারাপ থাকে, শরীরের সাথে সাথে মেজাজটাও খারাপ থাকে। তাই দিনরাত তাদেরকে বকাবকি করেন। বিজলীকে মা মনে হয় একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। কোনোদিন তার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন, বিজলী সেটা মনেই করতে পারে না।
বাড়িতে বিজলীর একমাত্র সাথী হচ্ছে খোকন। তাকে ছোট থেকে সে মানুষ করেছে, কোলে নিয়ে কাটিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, রাত্রে পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছে। যখন একটু বড় হয়েছে তখন রাজ্যের গল্প শুনিয়েছে। এই ছোট ভাইটাই বিজলীর একমাত্র আপন মানুষ। খোকন না থাকলে বিজলীর জীবনটা কেমন হতো সে চিন্তাও করতে পারে না।
প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর তারা নিচু জায়গাটাতে এসে হাজির হলো। ভাটির সময় এই জায়গাটা পানির নিচ থেকে বের হয়ে আসে। বড় বড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, পাথরগুলোর ধারালো কোনা বের হয়ে থাকে। জোয়ারের সময় এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে বিজলী জায়গাটা পার হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারপরেও শরীর না ভিজিয়ে পার হওয়া যায় না।
বিজলী খোকনের হাত ধরে এই নিচু এলাকাটা পার হয়ে আসে। এখানে-সেখানে পানি জমা হয়ে আছে, তার কোনো কোনোটিতে ছোট তারামাছ তিরতির করে নড়ছে।
নিচু জায়গাটা পার হয়ে দুজনে একটা বড় পাথরের মাঝে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল। জায়গাটা আশ্চর্য রকম নির্জন, আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। বহুদূরে ঝোঁপঝাড় গাছপালা, তার পেছনে আরো দূরে মানুষের জনবসতি। এরকম আশ্চর্য রকম নির্জন জায়গায় বসে থাকতে বিচিত্র এক ধরনের নিঃসঙ্গ অনুভূতি হয়।