আমি একটা গার্মেন্টসে কাজ করি। আয়েশা গার্মেন্টস।
ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, যেখানে আগুন লেগেছিল?
হ্যাঁ। বিজলী মাথা নাড়ল, আমি তখন ভেতরে ছিলাম।
ড্রাইভার এতক্ষণ আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে আসছে, এবারে সামনে ফাঁকা, প্যাডেলে চাপ দিয়ে বের হয়ে যাবে। বিজলী জিজ্ঞেস করল, কখন ছুটি হবে খোকনের স্কুল?
এই তো ছুটির সময় বারোটা। কিন্তু তুমি কেন জানতে চাইছ?
বিজলী হাসল, বলল, আমার একটা কাজ আছে। আপনি আবার খোকনকে নিতে আসবেন না?
হ্যাঁ।
তখন দেখবেন।
ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। বিজলী কিছুক্ষণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। এখন সকাল আটটা। বারোটা বাজতে আরো চার ঘণ্টা বাকি। তাকে এখন চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এই চার ঘণ্টা সময় সে কেমন করে কাটাবে?
বিজলী ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। খোকন তাকে দেখে কী করবে? চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে বলবে, বিজলীবু তুমি বলেছিলে, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। তুমি কেন তাহলে চলে গেলে।
তখন সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, এই তো আমি আবার চলে এসেছি! তোকে খুঁজে খুঁজে বের করেছি! বের করেছি কি না?
আসলে সে মনে হয় কিছু বলতে পারবে না। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সেও নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। রাস্তা দিয়ে যারা যাবে-আসবে তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কী ভাববে কে জানে। যা ইচ্ছে ভাবুক, এতদিন পর সে তার নিজের ভাইকে খুঁজে পেয়েছে, সে তার ভাইয়ের সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। কার তাতে কী আসে যায়?
বিজলী পথে পথে ঘুরে বেড়াল, খোকনের জন্যে একটা চকলেট কিনল। যখন কান্নাকাটি থামবে তখন সে এটা খোনকে খেতে দেবে। অনেক দামি বিদেশী চকলেট, খোকন নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।
বারোটার অনেক আগেই বিজলী স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল। স্কুল ছুটির পর বাচ্চাদের নিতে গাড়িগুলো এখনো আসতে শুরু করেনি। বিজলী গেটের কাছাকাছি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় তার বুকটা ধুকপুক করছে। খোকন আসলেই কি চিৎকার দিয়ে তার দিকে ছুটে আসবে? নাকি এতদিন পর দেখা হয়েছে বলে একটুখানি লজ্জা পাবে? দুই বছরে তার নিজের চেহারা কি অনেক পাল্টে গেছে? তাকে দেখে যদি না চেনে? বিজলী জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, যতই তার চেহারা পাল্টে গিয়ে থাকুক, তাকে চিনবে না এটা হতেই পারে না! সে একেবারে এইটুকুন থেকে খোকনকে বুকে ধরে বড় করেছে।
খোকন তাকিয়ে দেখল একটি একটি করে গাড়ি এসে থামছে এবং একটু পরে খোকনের নীল গাড়িটাও এসে থামল। বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায় এবং তখন লক্ষ করল পেছনের সিটে একজন মহিলা বসে আছে। মহিলাটি মিলি, বিজলী তাকে কখনো দেখেনি। মিলিকে দেখে বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার খোকন এখন আর পুরোপুরি তার নেই। সে যেরকম আদর করে খোকনকে বড় করেছে এখন অন্য একজন মহিলাও খোকনকে আদর করে বড় করছে। হঠাৎ করে বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে ওঠে।
পেছনের সিটে বসে থাকা মিলি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এল এবং গাড়ির ড্রাইভারও অন্য পাশ থেকে বের হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বাসায় গিয়ে মিলিকে বিজলীর কথা বলেছে, একজন অচেনা মেয়ে খোকনের খোঁজখবর নিচ্ছে শুনে মিলি নিজেই চলে এসেছে। মিলি দেখতে চায় কে খোকনের খোঁজ করেছে। কেন খোঁজ করেছে।
বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল, মিলির কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বলল, ম্যাডাম, এই যে, এই মেয়েটা খোকনের খোঁজ নিচ্ছিল।
মিলি বিজলীকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি খোকনের খোঁজ নিচ্ছিলে কেন?
বিজলী বলল, আমি বিজলী। খোকন আমার ছোট ভাই।
মিলি ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল, তারপর বিজলীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। খোকনের কোনো বোন নেই।
বিজলী হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, কাঁপা গলায় বলল, আছে। এই যে আমি। আমি খোকনের বোন। খোকন কখনো আপনাদের কাছে আমার কথা বলে নাই?
না। মিলি মাথা নাড়ল, খোকন কখনো তোমার কথা বলে নাই। সে কখনো বলে নাই যে তার অন্য কোনো ভাইবোন আছে।
বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!
এর মাঝে আশ্চর্যের কিছু নেই। তুমি কিছু একটা ভুল করেছ। তুমি যে খোকনের কথা বলছ নিশ্চয়ই এই খোকন সেই খোকন নয়। অন্য কোনো খোকন।
না। বিজলী শুকনো গলায় বলল, আমি অনেকদিন থেকে খোকনকে খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত আজকে খোকনকে পেয়েছি। খোকনকে আমি চিনি, আমি তাকে বড় করেছি।
মিলি একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে তুমি কেমন করে খোকনকে বড় করবে? তোমার কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমি খুব ভালো করে জানি খোকনের কোনো ভাইবোন নেই।
বিজলী কেমন যেন অসহায় অনুভব করে। কী বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে। খোকন আসুক–সে আমাকে দেখলে চিনবে।
না। মিলি মাথা নাড়ল, বলল, আমি চাই না তুমি খোকনকে কিছু বলো। আমরা জানি এবং খোকন জানে তার কেউ নেই। মা বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। এখন হঠাৎ করে তুমি যদি তাকে বোঝাতে শুরু করো যে তুমি তার বোন, সেটা মোটেও ভালো হবে না। আমি তোমাকে সেরকম কিছু করতে দেব না। তুমি যাও।