স্কুল শুরু হওয়ার সময় সে ঘণ্টাখানেক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রত্যেকটা ছেলেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যখন সব বাচ্চা ভেতরে ঢুকে যায় তখন সে একা একা পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, খোকনকে কীভাবে খুঁজে বের করবে চিন্তা করে। অনেক চিন্তা করে বিজলী একসময় বুঝতে পারল সে নিজে নিজে এভাবে আসলে খোকনকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তাকে বড় মানুষদের সাহায্য নিতে হবে। এখন পর্যন্ত কাউকে সে খোকনের কথা বলেনি। কেন বলেনি সে নিজেও জানে না। এখন সে অন্যদের খোকনের কথা বলবে। প্রথমে বলবে আফজাল চাচাকে। আফজাল চাচা মানুষটা খুব ভালো, বিজলীকে একেবারে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন। আফজাল চাচা দরকার হলে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকীর সাথে কথা বলবেন। তারা নিশ্চয়ই সেলিনা জাহানকে খুঁজে বের করতে পারবে। তখন সেলিনা জাহানকে নিয়ে যেতে হবে হ্যাপি চাইল্ডে। সেখানে সেই রাক্ষুসী নাজনীনের সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে খোকনের ঠিকানা নিতে হবে। সে নিজে যখন খোকনের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল তাকে ঠিকানাটা বলেনি। কিন্তু যখন বড় বড় মানুষ নাজনীনের কাছে খোকনের ঠিকানা জানতে চাইবে তখন সে আর না বলতে পারবে না। খোকনের ঠিকানা দিতেই হবে।
বিজলী পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটিতে নানা রকম শার্ট ঝুলছে। কী সুন্দর শার্ট, এরকম একটা শার্টে খোকনকে কী সুন্দর মানাবে! বিজলী দাঁড়িয়ে গেল, অনেক দরদাম করে সে শার্টটা কিনে নিল। যখনই বাইরে যায় তখনই সে খোকনের জন্যে কিছু কিনে ফেলে। শার্ট, প্যান্ট, জুতো, বই, খাতা, কলম এমনকি একটা ফুটবলও কিনে রেখেছে। খোকন কোথায় ফুটবল খেলবে সেটা অবশ্যি বিজলী জানে না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। বিজলীর মনে আছে তারা যখন চরে ছিল তখন বাচ্চারা সবাই মিলে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলত! খোকনকে আর জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতে হবে না। সত্যিকারের ফুটবল দিয়ে সে খেলতে পারবে।
আফজাল সাহেবকে খোকনের কথা বলতে গিয়েও বিজলী বলতে পারে না, ঠিক কেন সে বলতে পারে না, সে নিজেও জানে না। আগে হোক পরে হোক তার বলতে হবে, যে কয়দিন বলছে না সে কয়দিন তখনো সে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিজলীকে অবশ্যি আফজাল সাহেবকে কিছু বলতে হলো না, কারণ দুই দিন পর সে নিজেই খোকনের দেখা পেয়ে গেল।
.
স্কুলটা শহরের সবচেয়ে ভালো একটা স্কুল, যারা এখানে পড়তে আসে সবাই গাড়িতে করে আসে। স্কুল শুরুর সময়টাতে পুরো এলাকাতে একটা ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়। বিজলী গেটের কাছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটের দারোয়ান মাঝে মাঝেই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে, আগে হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত এখন সে ভালো কাপড় পরে থাকে, মুখটা শক্ত করে রাখে, তাই তাড়িয়ে দিতে সাহস পায় না।
স্কুলের বাচ্চাদের ভিড় যখন সবচেয়ে বেশি তখন একটা নীল রঙের গাড়ি থামল। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে একটা ছেলে বের হলো, ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে কিছু একটা বলল, তারপর ব্যাকপেকটা পেছনে ঝুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং তাকে দেখে বিজলী একটা চাপা আর্তনাদ করল। ছেলেটি খোকন।
.
খোকন একটুখানি বড় হয়েছে, কিন্তু তার চেহারা ঠিক আগের মতো আছে। গায়ের রং হয়তো আগের থেকে একটুখানি ফর্সা হয়েছে, স্বাস্থ্যটাও হয়তো একটুখানি ভালো হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া সবকিছু আগের মতো। বিজলীর মনে হলো সে বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কোনোমতে দেয়ালটা ধরে সে হাঁ করে খোকনের দিকে তাকিয়ে রইল। একবার মনে হলো সে চিৎকার করে থোকনের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে। কিন্তু সে ছুটে গেল না, তাকে গিয়ে জাপটে ধরল না। খোকন যতক্ষণ পর্যন্ত গেটের ভেতরে ঢুকে না গেল ততক্ষণ বিজলী দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ঢুকে যাবার পর সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে, কোনদিকে হাঁটছে সে নিজেই জানে না। সে এখনো ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, এখনো কেমন জানি একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে দেখল খোকনের নীল গাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, ট্রাফিক জ্যামের জন্যে বেরিয়ে যেতে পারছে না। বিজলী একটু এগিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার চাচা, খোকনের স্কুল ছুটি হবে কখন?
ড্রাইভার অবাক হয়ে গেল, উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
আমি বিজলী।
বিজলী ভেবেছিল তার নামটা বলামাত্র ড্রাইভার তাকে চিনে ফেলবে। খোকন নিশ্চয়ই অনেকবার তার কথা সবাইকে বলেছে। সবাই নিশ্চয়ই এত দিনে তার নাম জেনে গেছে। কিন্তু ড্রাইভার তাকে চিনল না। জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?
বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই ড্রাইভার তার নাম শোনেনি। এই ড্রাইভার জানে না খোকন তার আপন ভাই এবং অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত সে খোকনকে খুঁজে পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী এখন হঠাৎ করে যদি জানে সে বিজলী, খোকনের আপন বোন তখন এই ড্রাইভার মানুষটা ঘাবড়ে যেতে পারে। তাই তাকে এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?