স্যার আপনার জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেডি করেছেন।
বিজলীকে এর আগে কেউ কখনো আপনি করে বলেনি। এই প্রথম। সে জিজ্ঞেস করল, কোন স্যার?
রায়হান সিদ্দিকী স্যার।
আমার জন্য?
হ্যাঁ।
বিজলী অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আপনি এখানে একা আছেন শুনে স্যার একটু দুশ্চিন্তা করছেন।
আমি এইখানে একলা আছি স্যার সেইটা কেমনে জানলেন?
মানুষটা হাসল, বলল, স্যার সব সময় আপনার খোঁজ রাখেন। আপনাকে স্যার খুব স্নেহ করেন।
বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে আসলেই যাইতে হবে?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করেন, আমি আমার জিনিসগুলা গুছায়ে নেই।
মানুষটা বলল, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু না নিলেও কোনো সমস্যা হবে না।
কিছু না নিলেও সমস্যা হবে না?
না।
বিজলী তারপরেও তার কিছু জিনিসপত্র একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিল। নিচে খুব সুন্দর একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। মানুষটা তাকে গাড়িতে তুলে নিল, ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
মানুষটা তাকে একটা ঠিকানা বলে দিল।
রাস্তায় অনেক ভিড় তাই তাদের পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা হয়ে একটা ছিমছাম রাস্তাতে তাদের গাড়ি থেমে গেল। বিজলী মানুষটার সাথে রাস্তার পাশে একটা বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান মানুষটাকে একটা লম্বা সালাম দিল।
মানুষটা বিজলীকে নিয়ে একটা লিফটে করে পাঁচ-তলায় উঠে এল। বিজলী এই প্রথমবার একটা লিফটে উঠেছে, ছোট একটা লোহার ঘর মানুষজনকে নিয়ে উপরে উঠে যায়, নিচে নেমে আসে, কী আশ্চর্য!
লিফট থেকে নেমে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মানুষটা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চাবিটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে এইটা আপনার চাবি। এইটা আপনার অ্যাপার্টমেন্ট।
বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখল। এক বেডরুমের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। এক পাশে একটা কিচেন। দুটি বাথরুম। সামনে এক চিলতে বারান্দা। এতদিন সে তিনজন মেয়ের সাথে একটা ঘরে থেকে এসেছে, এখন থেকে তার নিজের জন্যে আস্তো একটা অ্যাপার্টমেন্ট?
বিজলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এইটার ভাড়া কত?
মানুষটা হাসল। বলল, এটা স্যারের বিল্ডিং। স্যারের স্টাফরা এখানে থাকে। এটায় কোনো ভাড়া নাই।
আ—আ–আমার ভাড়া দিতে হবে না?
না। মানুষটা হাসল। বলল, আমি ভেবেছিলাম ফার্নিচার ফ্রিজ এই সব কিনে দিই, স্যার না করলেন। স্যার বললেন এগুলো আপনি আপনার পছন্দমতো কিনে নেবেন। নিজে নিজে কিনতে নাকি বেশি মজা!
বিজলী কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজে নিজে ফার্নিচার ফ্রিজ কিনবে? ফ্রিজ কী সে জানে না। কখনো দেখেনি। ভেতরে খাবার ঠান্ডা থাকে বলে শুনেছে। সেই ফ্রিজ সে নিজে কিনে ফেলবে?
মানুষটা বলল, আমি এখন যাই। তারপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা আমার কার্ড। কোনো কিছু লাগলে আমাকে ফোন করবেন।
তারপর একটু এগিয়ে রান্নাঘরের কেবিনেটের একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে দেখিয়ে বলল, এইখানে কিছু টাকা আছে, আপনার কেনাকাটার জন্যে। আর একটা মোবাইল ফোন। সিমে আমার নাম্বারটা ঢোকানো আছে। আফজাল হোসেন নামে। যেকোনো দরকারে আপনি আমাকে ফোন করবেন। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনাকে দেখেশুনে রাখার জন্য।
বিজলী অনেকক্ষণ থেকে যে কথাটা বলতে চাইছিল সেটা শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল, আমারে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো অনেক ছোট–
মানুষটি হাসল, বলল, হ্যাঁ আমারও খুব কষ্ট করে আপনি বলতে হচ্ছে। কিন্তু স্যার আপনাকে খুব স্নেহ করেন, সেই জন্যে আপনি বলছি। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তুমি করে বলতে পারি।
বিজলী বলল, জি জি আফজাল চাচা আপনি আমারে তুমি করে বলবেন।
মানুষটা বলল, হ্যাঁ, বলব মা। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। তারপর বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। স্যার আমাকে বলেছেন তোমাকে দেখেশুনে রাখতে। স্যার না বললেও আমি তোমাকে দেখেশুনে রাখতাম।
মানুষটা চলে যাবার পর বিজলী অনেকক্ষণ বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে রইল। কী কারণ কে জানে তার চোখে একটু পরে পরে পানি চলে আসছিল। খোকনকে যখন খুঁজে পাবে তখন তাকে নিয়ে সে ফার্নিচার আর ফ্রিজ কিনবে। খোকনের যা যা পছন্দ সবকিছু কিনবে। ড্রয়ারে টাকার বান্ডিলটা অনেক বড়। তার গুনে দেখতেও ভয় করছে।
.
বিজলী পরের দিন ভোর থেকেই খোকনকে খুঁজতে শুরু করে দিল। একটা স্কুলে ছেলেমেয়েরা আসা শুরু করার আগেই সে সেই স্কুলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে দূর থেকে তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দুই বছর আগে খোকন তার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই দুই বছরে খোকন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে, কত বড় হয়েছে কে জানে। চেহারা তো নিশ্চয়ই আগের মতো আছে, বড় হওয়ার জন্যে একটুখানি বদলাতে পারে কিন্তু খুব বেশি নিশ্চয়ই বদলাবে না। তার চিনতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।
.
বিজলী পুরো এক মাস প্রত্যেক দিন সকালবেলা এক একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তখন ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল এইভাবে খোনকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন, বলা যেতে পারে প্রায় অসম্ভব। শহরে একটি-দুটি স্কুল নেই, একেবারে হাজার হাজার স্কুল। প্রত্যেকটা স্কুলে একদিন করে গেলেও পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। স্কুলের সময় যখন সব বাচ্চা এসে হাজির হয় তখন একটা সময় এক সাথে অনেক বাচ্চা হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে। সব বাচ্চাকে তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাও যায় না। কাজেই যে স্কুলে খোকন লেখাপড়া করে সেই স্কুলে গিয়েও তাকে খুঁজে নাও পেতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যি হয়তো বিজলী ঠিক স্কুলে হাজির হয়েছে কিন্তু সেদিন খোকন আসেনি, তাহলেও তাকে আর জীবনেও খুঁজে পাবে না।