কে যেন জিজ্ঞেস কলল, সবাই নেমেছে?
আরেকজন উত্তর দিল, হ্যাঁ।
আরেকজন বলল, খোদা মেহেরবান।
চিৎকার-চেঁচামেচিতে এরপর আর কারো কথা বোঝা গেল না।
.
ঠিক তখন জ্বলন্ত বিল্ডিংয়ের পাশে একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকী কোনোভাবে নেমে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জ্বলন্ত বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। একজন মানুষ তার কাছে ছুটে এসে কাঁপা গলায় বলল, স্যার শেষ হয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেল।
ভেতরে কয়জন ছিল?
একজনও নাই স্যার।
রায়হান সিদ্দিকী আর্তনাদ করে উঠল, একজনও নাই? সবাই মারা গেছে?
মানুষটা বলল, না না স্যার! আমি সেটা বলি নাই। আমি বলেছি ভেতরে একজনও নাই। সবাই বের হয়ে আসছে। একজনও মারা যায় নাই স্যার।
রায়হান সিদ্দিকী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, সবাই বের হতে পেরেছে? সবাই?
জি স্যার সবাই। উপর থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে—
সবাই? সবাই বেঁচে আছে? সবাই?
জি স্যার সবাই।
একজনও মারা যায় নাই?
না স্যার। একজনও মারা যায় নাই।
রায়হান সিদ্দিকী তার দামি স্যুট পরা অবস্থাতেই নোংরা ফুটপাথে বসে পড়ল। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর দুই হাতে নিজের মাথাটা ধরে বিড়বিড় করে বলল, থ্যাংক ইউ খোদা। থ্যাংক ইউ।
.
পরদিন ভোরবেলা বিজলী গিয়ে কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে এনেছে। সব পত্রিকায় গত রাতে আয়েশা গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়ার খবর ছাপা হয়েছে। বিজলী যখন তার মেসের মেয়েদের খবরের কাগজ থেকে খবরটা পড়ে শোনাচ্ছে তখন নিচ থেকে দারোয়ান এসে খবর দিল একজন মানুষ বিজলীকে খুঁজছে।
বিজলী একটু অবাক হয়ে নিচে নেমে এসে দেখল তাদের মেসের সামনের সরু গলিটাতে একটা বড় সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এল। বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম বিজলী? তুমি আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ করো?
বিজলী মাথা নাড়ল। মানুষটা বলল, আমি আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক, আমার নাম রায়হান সিদ্দিকী।
বিজলী হাত তুলে সালাম দিল। আয়েশা গার্মেন্টসের সবাই রায়হান সিদ্দিকীর নাম শুনেছে, কেউ তাকে আগে দেখেনি। রায়হান সিদ্দিকী কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে আমার ফ্যাক্টরির সবগুলো মেয়ের জান বাঁচিয়েছ?
বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।
বিজলী এবারেও কোনো কথা বলল না।
রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি মায়ের নামে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিটা দিয়েছি। যদি গত রাতে সেখানে কেউ পুড়ে মারা যেত তাহলে আমার মায়ের নামটিতে একটা অভিশাপ পড়ে যেত। আমি তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। তোমার জন্যে আমি আমার মায়ের সম্মানটা বাঁচাতে পেরেছি।
বিজলী প্রথমবার কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, কিন্তু আপনার তো অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেল–
রায়হান সিদ্দিকী হাত দিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার না। টাকা আসে যায়। এইবার গিয়েছে আরেকবার আসবে। মানুষের প্রাণ গেলে আর আসবে না। যাই হোক মা, আমি এই সকালে তোমার কাছে এসেছি বলার জন্যে যে তোমার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। তবু যদি কিছু একটা পারি তাহলে চেষ্টা করব। বলো তোমাকে আমি কী দিতে পারি।
বিজলী বলল, আমার কিছু লাগবে না।
সেটা তো হতে পারে না, বলো কিছু একটা।
কিছু লাগবে না।
রায়হান সিদ্দিকী বলল, কী বলছ কিছু লাগবে না। তোমার বয়সে, আমার কত কী শখ ছিল! কিছু একটা বলো।
বিজলী লাজুক মুখে বলল, বলব?
হ্যাঁ, বলো।
যখন আবার ফ্যাক্টরি চালু হবে তখন কি আমি দুই ঘণ্টা পরে কাজে আসতে পারি? বিকেলবেলা আমি বাড়তি দুই ঘণ্টা কাজ করে দিব–
রায়হান সিদ্দিকী চোখ বড় বড় করে বিজলীর কথা শুনল তারপর হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল।
বিজলী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রায়হান সিদ্দিকী কেন হাসছে সে বুঝতে পারল না। রায়হান সিদ্দিকী একসময় হাসি থামিয়ে বলল, তুমি যখন খুশি কাজে এসো আর যখন খুশি চলে যেয়ো। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না! তোমাকে আমি আমার আয়েশা গার্মেন্টসের এম্বাসাডার বানিয়ে দেব। তুমি ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবে। পারবে না?
বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে যেটা চেয়েছিল সেটা সে পেয়ে গেছে। সে আবার খোকনকে খোঁজা শুরু করতে পারবে।
.
পরদিন থেকে বিজলী আবার খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে শুরু করল।
*
আয়েশা গার্মেন্টস দুই মাসের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা এখানে কাজ করে তারা মহাখুশি, কারণ ঘোষণা করা হয়েছে এই দুই মাস সবাইকে বেতন দেওয়া হবে। কেউ এরকম কিছু জন্মেও শোনেনি যে কাজ না করেও কেউ বেতন পেতে পারে। অনেকেই এটা বিশ্বাসই করতে পারছে না, গোপনে বলাবলি করছে এটা আসলে সবাইকে ছাঁটাই করার ফন্দি!
যেহেতু দুই মাসের ছুটি, সবাই বাড়ি চলে গেল–এখন বিজলী পুরো মেসে একা। সেটা নিয়ে তার নিজের কোনো সমস্যা নেই। সে প্রায় এক বছর সময় রাস্তায় কাটিয়েছে, তার জন্যে একটা মেসে একা থাকা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু দেখা গেল একদিন একজন মানুষ তাকে নিতে চলে এসেছে। বিজলী অবাক হয়ে বলল, কোনখানে যেতে হবে আমাকে?