একজন চোখ কপালে তুলে বলল, আর আমি কী পরে থাকব?
ব্লাউজ পেটিকোট আছে না? উপরে একটা কোট পরে নাও, মেম সাহেবদের মতো।
এরকম বিপদের মাঝে কে কী পরে আছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, ঝটপট দুইটা শাড়ি চলে এল। বিজলী প্রথমে দুইটা শাড়ি গিঁট দিয়ে সেটাকে লম্বা করে নেয়। তারপর এক পাশে একটা বড় ফঁসের মতো করল যেন একজন সেখানে বসতে পারে। এখন একজন একজন করে সেখানে বসিয়ে তাকে উপর থেকে ঝুলিয়ে নিচে নামিয়ে দেয়া হবে।
যখন এখান থেকে বের হবার কোনো উপায় ছিল না তখন সবাই। আতঙ্কে চিৎকার করছিল। এখন যখন দেখতে পেল বেঁচে যাওয়ার একটা পথ তৈরি হয়েছে, তখন হঠাৎ করে সবার মাঝে একটা সাহস ফিরে এসেছে। তারা চিৎকার থামিয়ে এবারে অপেক্ষা করতে থাকে।
বিজলী জিজ্ঞেস করল, কে আগে নামবা?
সবাই আগে নামতে চায় আবার কেউই এই বিপজ্জনক ফাঁসে প্রথম বসতে চায় না। চার-তলার উপর থেকে এভাবে কেউ নামতে সাহস পায় না, ভয়ার্ত চোখে নিচে তাকিয়ে থাকে। বিজলী আবার চিৎকার করে বলল, দেরি করলে হবে না, একজন একজন করে সবাইরে নামতে হবে!
শেষ পর্যন্ত একজন সাহসী মেয়ে রাজি হলো। তাকে শাড়ির ফাঁসটাতে বসিয়ে সাবধানে গ্রিলের ফুটো দিয়ে বের করা হলো। তখন সবাই মিলে শাড়িটার অন্য পাশে ধরে তাকে নিচে নামাতে থাকে। নামার সময় সে মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এ ছাড়া কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই সে বেশ সহজেই নিচে পৌঁছে গেল।
প্রথম মেয়েটি নেমে যাবার পর সবার সাহস একটু বেড়ে গেল। এবারে অনেকেই নামতে রাজি। প্রথমবার যে ছোটখাটো সমস্যা হয়েছিল পরেরবার তার কিছুই হলো না। নামার সময় ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক পর্যন্ত খেল না। বারান্দার নিচে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তখন আশেপাশে জমা হয়ে থাকা মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। তারা নিচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল এবং কাছাকাছি আসতেই মেয়েগুলোকে ধরে ধরে নামাতে লাগল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো তাড়াহুড়ো করল না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য একজনের আগে আরেকজন নামার চেষ্টা করল না। যারা খুব বেশি ভয় পেয়েছিল সবাই মিলে তাদেরকেই আগে নামিয়ে দিল। প্রথম প্রথম সবাই মিলে শাড়িটা ধরে রেখে খুব সাবধানে একেকজনকে নামাচ্ছিল, আস্তে আস্তে তাদের সাহস বাড়তে থাকে। শাড়িটাকে গ্রিলের সাথে দুইবার প্যাচিয়ে নেবার পর একজনই একজনকে নামাতে পারছিল। শাড়িটাকে একটুখানি ঢিলে দিলে মানুষটা নামতে থাকে, আবার টেনে ধরলেই আটকে যায়। হঠাৎ করে কেউ হাত পিছলে পড়ে যাবে তার ভয় নেই। নিচে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা ধরে ফেলবে।
মাঝে মাঝে হঠাৎ একজন বের হয়ে যায় যে আতঙ্কে নড়ার সাহস পায় না। তখন চিৎকার করে, ঠেলে, জোর করে তাকে শাড়িটার ফঁসে বসিয়ে নিচে নামাতে হয়। নিচে অনেক মানুষ দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে মোটামুটি কাছাকাছি এলে কিছুটা উপর থেকেই খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া যাচ্ছে, যারা নিচে আছে তারা সবাই মিলে তখন তাকে ধরে ফেলছে।
যখন বেশির ভাগ মেয়ে নেমে গিয়েছে তখন হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, যে সবচেয়ে শেষে নামবে তারে কে নামাবে?
বিজলী বলল, তার নিজে নিজে নামতে হবে।
নিজে নিজে? নিজে নিজে কীভাবে নামবে?
শাড়িটা গ্রিলের সাথে বেন্ধে সেটা ধরে পিছলে পিছলে নামবে।
সব্বোনাশ! যদি হাত ছুটে যায়?
বিজলী বলল, ছুটবে না। আমি নাম সবার শেষে।
বিল্ডিংটাতে তখন আগুন অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে। সিঁড়ির দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া এসে পুরো ঘরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। সবাই খক খক করে কাশছে। এতক্ষণ ইলেকট্রিসিটির আলো ছিল, হঠাৎ করে আলোটা নিভু নিভু হয়ে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। দরজার নিচ দিয়ে আগুনের আভা ছাড়া আর কোনো আলো নেই। পুরো ঘরটা ভয়ংকর গরম, সবাই দরদর করে ঘামছে। ধোঁয়ায় একেকজনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ধীরে ধীরে প্রায় সবাই নেমে গেছে, শুধু বিজলী আর একটি মেয়ে বাকি, তখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে সিঁড়ির দরজাটা খুলে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ঘরের ভেতর দাউ দাউ আগুন, তার প্রচণ্ড তাপে বিজলীর সমস্ত শরীর যেন ঝলসে গেল।
বিজলী চিৎকার করে বলল, আর দেরি করা যাবে না। এখনই শাড়ি ধরে নামতে হবে।
বিজলী আর মেয়েটি মিলে তাড়াতাড়ি শাড়িটা গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে গিটটা পরীক্ষা করে প্রথমে অন্য মেয়েটি শাড়িটা ধরে ঝুলে পড়ে। আগুনের ফুলকি ছুটে আসছে, প্রচণ্ড তাপে সে মনে হয় প্রায় ঝলসে গেল! বিজলী দেখল অন্য মেয়েটি সর সর করে নেমে যাচ্ছে। মেয়েটি একেবারে নিচে পৌঁছানো পর্যন্ত বিজলী অপেক্ষা করল না। তার আগেই সে শাড়িটা ধরে নামতে শুরু করে। একসাথে দুজনের ওজন শাড়িটা সহ্য করতে পারবে কি না বিজলী জানে না কিন্তু এখন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বিজলী কাপড়টা ধরে প্রায় পিছলে নিচে নামতে থাকে, মনে হয় হাতের তালুর ছাল উঠে গেল, কিন্তু সে শাড়িটা ছাড়ল না। বিজলী এত তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল যে সে নিচের মেয়েটিকে ধরে ফেলল, তার পায়ের ধাক্কায় মেয়েটির হাত ছুটে যায়, মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে কিন্তু ততক্ষণে সে প্রায় নিচে নেমে এসেছে। নিচে যারা ছিল তারা মেয়েটিকে ধরে ফেলল। বিজলী দুই হাত দিয়ে কাপড়টা ধরে ঝুলতে থাকে। বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে আগুনের ফুলকি নিচে এসে পড়ছে, যারা নিচে ছিল তারা ভয় পেয়ে সরে যেতে থাকে। বিজলী তখনো ঝুলে আছে, দুই পা দিয়ে শাড়িটা ধরে রাখার চেষ্টা করল, তারপর আবার পিছলে নিচে নেমে এল। উপর থেকে আবার বিস্ফোরণের একটা শব্দ এল এবং তখন দাউ দাউ করে পুরো চারতলাটি জ্বলতে শুরু করল। বিজলী এবারে তার হাতটি ছেড়ে দিয়ে বেশ উপর থেকে নিচে এসে পড়ল।