খোকনকে খুঁজে পাওয়ার পর সে কী করবে তার খুঁটিনাটি সবকিছু সে চিন্তা করে রেখেছে কিন্তু খোকনকে সে খুঁজে পায়নি–শুধু যে খুঁজে পায়নি তা নয় তাকে কীভাবে খুঁজে পাবে, সেটাও সে জানে না। আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর সে আর খোকনকে খুঁজতে পারছে না। এখন তাকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাজে যেতে হয়, তাই সে আর খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে পারে না। সে আবার কেমন করে খোকনকে খোঁজা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। গোপনে সে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজছে, যেখানে দেরি করে কাজে যেতে পারবে। কিন্তু সে যে কোনো হিসেবে একটা বাচ্চা মেয়ে, তাকে রওশন আরা এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে, সে চেষ্টা করলেই অন্য জায়গায় চাকরি পাবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু হঠাৎ করেই বিজলী খোকনকে খোঁজার সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু যেভাবে সুযোগটা এল সেটা এতই অভাবনীয় ছিল যে বিজলী তার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
.
আয়েশা গার্মেন্টসে একটা অর্ডার এসেছে, সেটা সময়মতো শেষ করতে না পারলে ঝামেলা হবে। সেজন্যে অনেককে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে। তাদের মাঝে বিজলীও একজন। একটা মেশিন দিয়ে সে শার্টের বোতাম লাগিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ।
রাত দশটার দিকে তারা আধাঘণ্টার বিশ্রাম পেল, হোটেল থেকে খাবারের প্যাকেট আনা হয়েছে, সবাই ছাদে বসে খাওয়া শেষ করে আবার চারতলায় নেমে এসেছে। তখন তাদের একজন নাক কুঁচকে বলল, কিসের গন্ধ?
আরেকজন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, কই? আমি তো কোনো গন্ধ পাই না।
সবাই তখন আবার কাজে লেগে গেল এবং কয়েক মিনিট পর সবাই একসাথে একটা পোড়া গন্ধ পেল। একজন উঠে গেল গন্ধটা কোথা থেকে এসেছে দেখবার জন্যে এবং সিঁড়ির কাছে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখল সিঁড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আসছে। সে চিৎকার করে দরজাটা বন্ধ করে ছুটে এসে বলল, আগুন!
তখন একসাথে সবাই লাফ দিয়ে উঠে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কয়েকজন আবার গিয়ে দরজাটা খুলে বোঝার চেষ্টা করল আগুনটা কোথায়, সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমে যেতে পারবে কি না। কিন্তু এবারে দরজা খোলার সাথে শুধু কুচকুচে কালো ধোয়া নয় আগুনের হলকা দেখতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার কোনো উপায় নেই।
।একটি মেয়ে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, আর সিঁড়ি নাই?
আছে, পিছনে আরেকটা সিঁড়ি আছে।
এবারে সবাই পেছনে ছুটে গেল, কিন্তু সিঁড়ির দরজাটা বাইরে থেকে তালা মারা, তারা বৃথাই কয়েকবার লাথি দেয় সেটাকে ভাঙার চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না।
এবারে বেশ কয়েকজন ডুকরে কেঁদে উঠল। কয়েকজন জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে। রাস্তায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কী বলছে বোঝার কোনো উপায় নেই।
অনেকগুলো মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে। বাইরে আগুনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরের ভেতর দেখতে দেখতে গরম হয়ে উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে পারবে না, উপরেও উঠতে পারবে না, দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে–হঠাৎ করে সবার ভেতরে একধরনের মৃত্যুভয় ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই চিৎকার করে খোদাকে ডাকতে থাকে। কেউ যখন মৃত্যুভয়ে খোদাকে ডাকাডাকি করে তার চাইতে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।
বিজলী মাথা ঠান্ডা রাখল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে না, আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ার আগে তাদেরকে অন্য কোনোভাবে নেমে যেতে হবে। পেছনে বারান্দা আছে কিন্তু সেখানে গ্রিল দেয়া, সুলতানার সাথে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাবার পর থেকে সে কোনো গ্রিল দেখলেই সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, চাপ দিয়ে খুলে ফেলা যায় কিনা পরীক্ষা করে। এই বিল্ডিংয়ের বারান্দার গ্রিলটাও সে পরীক্ষা করেছে। গ্রিলটা খুবই দুর্বল, কোনো কিছু দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। একটা খন্তা হলে খুব ভালো হতো, কিন্তু এখানে কোনো খন্তা নেই।
বিজলী একটু চিন্তা করল।
তাদের টেবিলের উপর ভারী কিছু যন্ত্রপাতি আছে, ধরাধরি করে সেগুলো নিয়ে সেটা দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলে নিশ্চয়ই গ্রিল খুলে আসবে। বিজলী দেরি করল না, চিৎকার করে বলল, আপুরা কয়েকজন আস আমার সাথে।
একজন আতঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কেন?
বারান্দার গ্রিল ভাঙতে হবে। তাড়াতাড়ি।
বিজলী টেবিলের উপর রাখা একটা দামি মেশিনের পাওয়ার কর্ডটা খুলে ফেলল। চিৎকার করে বলল, ধরো।
বেশ কয়েকজন সেটা ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে আসে, তারপর সেটাকে দিয়ে প্রাণপণে গ্রিলকে ধাক্কা দিল। দুইবার ধাক্কা দিতেই এক পাশ থেকে গ্রিলটা ছুটে আসে। তখন উৎসাহ পেয়ে আরো কয়েকজন হাত লাগাল। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত গ্রিলের অনেকখানি খুলে গেল। এবারে বেশ কয়েকজন গ্রিলটাকে টেনে অনেকখানি জায়গা করে নেয় যেন সেদিক দিয়ে একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারে।
সবাই তখন বারান্দায় এসে ভিড় করে ঠেলাঠেলি শুরু করেছে, কিন্তু চারতলার বারান্দা থেকে কীভাবে নিচে নামবে কেউ বুঝতে পারছে না।
বিজলী তখন সবার দিকে তাকালো। বেশির ভাগের পরনে সালোয়ার কামিজ, কয়েকজন মাত্র শাড়ি পরে এসেছে। তাদের শাড়িগুলো দরকার। বিজলী চিৎকার করে বলল, আপুরা, যারা সুতি শাড়ি পরে আছ, শাড়ি খুলে দেও। তাড়াতাড়ি!