বিজলী পেছনে পেছনে ধর ধর বলে চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল। হাতের ব্যাগটা ঘুরিয়ে সে মানুষটাকে মারার চেষ্টা করল। মানুষটার মাথায় কোথাও ব্যাগটা লেগেও গেল, তারপরেও কোনোভাবে তারা পালিয়ে গেল।
মোটরসাইকেলটা মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর বিজলী প্রথমবার ঘুরে তাকালো, যে মহিলার ব্যাগ নিয়ে এত ঘটনা সেই মহিলা ফুটপাথ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চোখে বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। বিজলী ব্যাগটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন। আপনার ব্যাগ।
মহিলা ব্যাগটা হাতে নিতে ভুলে গেল, চোখ বড় বড় করে সে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, বাবা, তোমার কী মাথা খারাপ।
বিজলী হাসার চেষ্টা করল, বলল, না আন্টি। আমার মাথা ঠিক আছে।
তুমি এটা কী করলে? তোমার এত সাহস? এই সন্ত্রাসীদের সাথে তুমি মারামারি করতে গিয়েছ? তোমাকে তো খুন করে ফেলত!
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, করবার পারে নাই।
তুমি এত বড় মানুষটাকে এভাবে মার দিলে? ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দিলে?
বিজলী কোনো কথা বলল না, হাসার চেষ্টা করল। হাতের ব্যাগটা সে মহিলাটার হাতে দিয়ে বলল, নেন আপনার ব্যাগ।
মহিলা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। এই ব্যাগটা নিয়ে গেলে আসলেই আমি খুব বিপদে পড়ে যেতাম। ব্যাগে টাকাপয়সা বেশি নাই, কিন্তু অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, বাবা।
বিজলী কোনো কিছু বলল না, আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা অবাক হয়ে এখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে আছে।
বিজলী যখন চলে যাচ্ছে, মহিলাটি আবার তাকে ডাকল, বলল, বাবা, তুমি এইটুকুন ছেলে, তোমার এত সাহস হলো কেমন করে?
বিজলীর কী মনে হলো কে জানে, হঠাৎ করে সে মহিলাটার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি আসলে ছেলে না। আমি মেয়ে।
মহিলাটি চমকে উঠল, মুখে হাত দিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, কী বললে?
বিজলী দ্বিতীয়বার কথাটি না বলে শুধু মাথা নাড়ল।
মহিলাটি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, চাপা গলায় বলল, তুমি ছেলে সেজে আছো কেন?
বিজলী এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, আমি পথেঘাটে থাকি তো সেই জন্যে। মেয়েদের পথেঘাটে থাকলে অনেক বিপদ।
মহিলাটি কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি লেখাপড়া জানো?
ক্লাস নাইন পর্যন্ত।
তুমি চাকরি করতে চাও?
আমাকে কে চাকরি দেবে?
আমি ব্যবস্থা করে দিব। গার্মেন্টসে। করবে?
বিজলী উত্তেজিত হয়ে বলল, করব। অবশ্যই করব।
মহিলাটি তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে কার্ডটা রাখো। তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে। ঠিক আছে?
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
কার্ডটা হারিও না যেন।
বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, হারাব না।
আমি তোমাকে নিজেই নিয়ে যেতাম কিন্তু এখন আমার খুব একটা জরুরি কাজে যেতে হবে। তুমি যোগাযোগ করবে।
বিজলী বলল, করব।
বিজলী কার্ডটা শক্ত করে ধরে রাখল, এর আগে তাকে কার্ড দিয়েছিল সেলিনা জাহান। সেই কার্ডটা নাজনীন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বলে তার পুরো জীবনটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। এবার সে এই মহিলার দেওয়া কার্ডটা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কিছুতেই না।
» ৪. মহিলার নাম রওশন আরা
মহিলার নাম রওশন আরা। বিজলী রওশন আরার সাথে যোগাযোগ করল এবং আয়েশা গার্মেন্টস নামে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে তার চাকরি হয়ে গেল। চাকরির থেকে বড় কথা গার্মেন্টসের আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।
রওশন আরা বিজলীর জন্যে সাবান, তোয়ালে, টুথপেস্ট, এর সাথে সাথে দুই জোড়া সালোয়ার-কামিজ কিনে এনেছে। প্রথম দিন বিজলীকে তার নতুন জায়গায় তুলে দেবার সময় গার্মেন্টসের মেয়েরা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, কিন্তু এইখানে তো আমরা শুধু মেয়েরা থাকি। ছেলেদের আলাদা মেস আছে–
বিজলী একটু হেসে বলল, আপু আমারে একটু সময় দেও, আমি মেয়ে হয়ে যাব!
মেয়েগুলো বিভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিজলী বলল, আমি আসলে মেয়ে! রাস্তাঘাটে থাকতাম সেই জন্যে ছেলে হয়ে ছিলাম।
রওশন আরা হেসে বলল, বিজলী মেয়ে হলেও তার তেজ কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি। একটা পাজি ছিনতাইকারী আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে গিয়েছিল, বিজলী তাকে এমন একটা ঘুষি দিল যে এক ঘুষিতে সেই সন্ত্রাসী ধড়াম করে পড়ে গেল!
মেয়েগুলো অবাক হয়ে রওশন আরাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং রওশন আরাকে তখন পুরো কাহিনীটা আরো একবার শোনাতে হলো।
.
বিজলী বাথরুমে ঢুকে বহুদিন পরে সারা শরীরে সাবান ঘষে পানি দিয়ে ভালোভাবে গোসল করল। ছেলে হয়ে থাকার এটাই ছিল সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা, কখনো সে ঠিক করে গোসল করতে পারেনি। গোসল শেষ করে সে বহুদিন পর সালোয়ার-কামিজ পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। মাথায় ছোট ছোট চুল থাকার পরও অনেকদিন পরে আজকে সে পুরোপুরি মেয়ে! বিজলী একটা ছোট আয়নায় অনেকক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক কী কারণ জানা নেই আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার চোখে পানি এসে গেল।
.
আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর বিজলীর জীবনটা পাল্টে গেল। সবাইকে নিয়ে সে দলবেঁধে কাজ করতে যায়। সেই ভোরবেলা থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে। দুপুরে খাবার সময় আয়েশা গার্মেন্টসের সাততলা ছাদে বসে সে সবার সাথে খায়। সবার মাঝে বিজলী সবচেয়ে ছোট, তাই অন্য মেয়েগুলোও তাকে নিজের বোনের মতো আদর করে। রাস্তাঘাটের জীবন থেকে এই জীবনটা একেবারেই অন্যরকম। ছুটির দিনে বিজলী অন্য মেয়েদের সাথে ঘুরতে যায়। কখনো সিনেমা দেখে, কখনো নিউমার্কেটে কেনাকাটা করে, কখনো চিড়িয়াখানায় যায়। প্রায় সবারই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের মাসে মাসে সেখানে টাকা পাঠাতে হয়। বিজলীর কেউ নেই, তার টাকা খরচ করারও কোনো জায়গা নেই। যখন রাস্তাঘাটে থাকত তখন টাকাগুলো তার প্যান্টের ভেতরে সেলাই করে লুকিয়ে রাখত। এখন সে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। যখন খোকনের সাথে দেখা হবে তখন সে খোনকে সাইকেল কিনে দেবে। নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে। প্লেনে করে খোকনকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে। কক্সবাজার যাবার আগে সে একটা ক্যামেরা কিনবে, তারপর খোকনকে নিয়ে সে ছবি তুলবে। অনেক অনেক ছবি।