বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, বুঝলাম না।
আয় দেখাই। বলে ছেলেটা দেখাল কীভাবে শুধু হাতের শক্তি ব্যবহার না করে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে কাউকে ঘুষি দিতে হয়। শুধু তাই না কীভাবে শুধু এক হাত দিয়ে ঘুষি না মেরে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়। মারামারি করার সময় কীভাবে সবদিকে নজর রাখতে হয়। কেউ চাকু মেরে দিবে কিনা সেটা কেমন করে আন্দাজ করতে হয়।
বিজলী মারপিট-সংক্রান্ত ব্যাপারে ছেলেটার জ্ঞান দেখে মোটামুটি মুগ্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তুমি এইগুলা কেমনে শিখছ?
আমার ওস্তাদ শিখাইছে।
তোমার ওস্তাদ কে?
বখতিয়ার ভাই।
বখতিয়ার ভাই কই থাকে?
মাটির নিচে।
বিজলী অবাক হয়ে তাকালো, মাটির নিচে?
ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খরচা হয়া গেছে।
কীভাবে?
ক্রসফায়ার। ছেলেটা হাত দিয়ে তার খরচা হয়ে যাওয়া ওস্ত দিকে সালাম দিয়ে বলল, আমার ওস্তাদ ছিল একেবারে আসল বাঘের বাচ্চা বাঘ। তারপর জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ছেলেটা যেহেতু আর কোনো কথা বলল না তাই বিজলী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দুজন চুপচাপ বসে রইল।
সিগারেট শেষ করে ছেলেটা সেটা ফুটপাথে ঘষে আগুন নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কই থাকিস?
রাস্তায়। ইস্টিশনে।
বাড়ি থেকে পালাইছস?
না।
বাপ মা?
নাই। সাইক্লোনে ভেসে গেছে।
কী করবি ঠিক করছস?
বিজলী মাথা নাড়ল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়া।
কী করবি?
আমার একটা ভাই আছে, আমারে না জানাইয়া তারে পালক দিয়া দিছে। তারে খুঁজে বের করমু।
ছেলেটা বিজলীর দিকে তাকাল, তারপর হা হা করে হেসে ফেলল, বলল, ঢাকা শহরে দুই কোটি লোক থাকে। দুই কোটি লোকের মাঝ থেকে তুই তোর ভাইরে খুঁজে বের করবি?
বিজলী মাথা নাড়ল, মুখ শক্ত করে বলল, হ্যাঁ। খুঁজে বের করমু। খোদার কসম।
কীভাবে?
সেইটা এখনো ঠিক করি নাই, কিন্তু বের করমুই করমু। তারে যদি খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে আমার বাঁইচা থাকার কোনো দরকার নাই।
ছেলেটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
দুজনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল, ছেলেটা পিচিক করে ফুটপাথে থুতু ফেলে বলল, তুই যদি আমার লগে কাজ করতে চাস তাহলে বলিস।
তোমার কী কাজ?
এখন বলা যাবে না। যদি কাজ করবার চাস তখন বলুম।
বিজলী বলল, ঠিক আছে।
.
শুধু হাত দিয়ে ঘুষি না দিয়ে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে ঘুষি দেওয়ার টেকনিকটা দুই দিন পরেই বিজলীর কাজে লাগল।
বিজলী একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক দিনই সকালবেলা যখন মায়েরা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায় সে তখন কোনো একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা বাচ্চাকে লক্ষ করে। খোকনকে নিশ্চয়ই তার পালক বাবা-মা কোনো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই স্কুলে নিশ্চয়ই সকালবেলা খোকনকে নামিয়ে দেবে। কাজেই একটা একটা করে সে যদি প্রত্যেকটা স্কুলে সকালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কোনো না কোনোদিন নিশ্চয়ই খোকনকে খুঁজে পাবে। বিজলী তাই ভোরবেলা কোনো একটা স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আজকেও বিজলী দাঁড়িয়ে ছিল, যখন শেষ গাড়িতে শেষ মা তার ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখন বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে যেতে থাকে।
রাস্তার মোড়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়েছিল, বাচ্চাকে নামিয়ে নিজের গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে ঠিক তখন রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা মোটরসাইকেল ছুটে এল, মোটরসাইকেলের সামনে কালো চশমা পরা একজন মানুষ, পেছনে আরেকজন। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে পেছনের মানুষটা খপ করে মহিলার হাতব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মহিলা তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। মোটরসাইকেলটা বাঁকা হয়ে ঘুরে গিয়ে আবার সোজা হয়ে গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। মোটরসাইকেলটা ঠিক যখন বিজলীর সামনে চলে এসেছে, তখন কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী খপ করে ছিনিয়ে নেওয়া হাতব্যাগটা ধরে ঝুলে পড়ল। মোটরসাইকেলটা কিছুদূর বিজলীকে টেনে নিল, তারপর তাল হারিয়ে কাত হয়ে গেল এবং পেছনের মানুষটা মোটরসাইকেল থেকে নিচে পড়ে গেল। পুরো মোটরসাইকেলটাই কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কালো চশমা পরা মানুষটা কোনোভাবে তার পা দিয়ে সামলে নিল।
যে মানুষটা ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েছিল সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা ছোট ছেলে এরকম কাণ্ড করতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। পড়ে গিয়ে মানুষটার হাত-পা ছড়ে গিয়েছে, সে দাঁত কিড়মিড় করে বিজলীর দিকে তাকালো। তারপর ব্যাগটা এক হাতে ধরে রেখে অন্য হাতটা পকেটে ঢুকিয়েছে। বিজলী জেনে গিয়েছে পকেটে মানুষ হাত ঢোকায় অস্ত্র বের করার জন্য, কাজেই কখনো সেই সুযোগ দিতে হয় না। সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তারপর কয়েকদিন আগে শেখা সমস্ত শরীর দিয়ে ঘুষি মারার টেকনিক ব্যবহার করে মানুষটার মুখে একটা ঘুষি মারল। বিজলী অবাক হয়ে দেখল তার ঘুষি খেয়ে মানুষটা কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে গেছে! বিজলী তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে নেয়।
যে মানুষটা মোটরসাইকেলে বসেছিল, সে চিৎকার করে উঠল। তখন নিচে পড়ে থাকা মানুষটা কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, টলতে টলতে কোনোমতে ছুটে গিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে গিয়ে বসে। মোটরসাইকেলটা তখন গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে।