মহিলাটা হাত বাড়িয়ে বলল, নাও বাবা। ছেলে থেকে বাবাতে নেমে এসেছে, বিজলী ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নোটটা হাতে নিল। আজকে সারা দিনের ব্যবসা এটা দিয়েই হয়ে গেছে। এখন আর গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াদৌড়ি না করলেও চলবে।
সামনে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হয়েছে, গাড়িগুলো নড়তে শুরু করেছে। বিজলী মহিলার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে সালাম দিয়ে সরে এল।
বিজলী চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাথে উঠে এল। হঠাৎ শুনতে পেল তার পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন চাপা গলায় বলল, হারামজাদা।
বিজলী মাথা ঘুরে তাকালো, তার মতোই কিছু বই নিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের দৃষ্টিতে আগুন বের হচ্ছে। মানুষটা কেন খেপে আছে বিজলী বুঝে গেল, কিন্তু সে না বোঝার ভান করল, কী হয়েছে?
তুই কী করছস মনে করছিস আমি দেখি নাই?
কী করছি?
হারামজাদা। ঢং করার জায়গা পাস নাই?
খবরদার মুখ খারাপ করে কথা বলবা না।
বললে তুই কী করবি? লোকটা এবারে আরো খারাপ ভাষায় বিজলীকে তার মা-বাবা তুলে গালি দিল।
বিজলী অবলীলায় মানুষটাকে তার মা-বাবা তুলে একই ভাষায় একই ভঙ্গিতে গালি দিল। মানুষটা প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে এইটুকুন একটা ছেলে তার মতো একজন বড় মানুষকে এই ভাষায় গালি দিতে পারে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এইটা আমার জায়গা। এই জায়গায় তুই কুনো জিনিস বেচবার পারবি না।
বিজলী বলল, এইটা তোমার বাপের জায়গা না। এইটা গভর্মেন্টের জায়গা। এইখানে যার খুশি সে আসতে পারব।
মানুষটা বলল, এইটা আমার জায়গা, ভাগ এখান থেকে। ভাগ। বলে মানুষটা কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বিজলীকে ধাক্কা দিল।
বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে হবে। সে খুবই শান্তভাবে তার হাতের টাকাগুলো পকেটে রাখল। বইগুলো মাটিতে রেখে কোমরে হাত দিল, বলল, তুমি কী বলো?
মানুষটা এবারে শুধু যে ধাক্কা দিল তা না, তার মুখে একটা চড় মারার চেষ্টা করল। বিজলী সময়মতো মাথা সরিয়ে নিয়ে মানুষটাকে একটা ঘুষি দিল। মানুষটা প্রস্তুত ছিল না, ঘুষি খেয়ে পিছিয়ে গেল এবং তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিল। দুই হাত ছড়িয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে তার হাতের সবগুলো বই নিচে ছড়িয়ে পড়ে গেছে। বিজলী একটা বইকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
দেখতে দেখতে তাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে গেল এবং বিজলীর সাথে মানুষটার একটা তুমুল মারামারি শুরু হয়ে যায়। মানুষটা বড়, গায়ে জোর বেশি। বিজলী ছোট গায়ে জোর কম কিন্তু সে মানুষটার থেকে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। পথে থাকতে থাকতে সে অনেক কিছু শিখেছে, মারামারিতে গায়ের জোর থেকে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে সাহস আর মনের জোর।
মারামারিতে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে সেটা অবশ্যি দেখার সুযোগ হলো না কারণ তার আগেই যারা দর্শক তাদের অনেকে গিয়ে দুজনকে সরিয়ে দিল। একজন পুলিশও এসে দুজনকে ধমকাধমকি করতে থাকে কিন্তু বোঝা গেল সহানুভূতিটা বিজলীর জন্যই বেশি। মানুষটা গজরাতে গজরাতে নিচ থেকে তার বইগুলো তুলতে থাকে। কয়েকজন মিলে বিজলীকে ধরে রাখল এবং সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করতে করতে মানুষটার দিকে ছুটে আসার ভাণ করতে লাগল।
ট্রাফিকের লাল সিগন্যাল হওয়ার পর যখন গাড়িগুলো আবার থেমে গেল তখন কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে বিজলী আবার তার রংচঙে বই নিয়ে গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াতে লাগল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটি অত্যন্ত কঠিন মুখে রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। বোঝা গেল তার এলাকাতে সে বিজলীর দখলদারি মেনে নিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলা বিজলী যখন ফুটপাথে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন তার পাশে একটা ছেলে এসে বসল। সে আশেপাশে থাকে, কখনো তাকে রাস্তায় কিছু বিক্রি করতে দেখা যায়নি কিন্তু দেখেই বোঝা যায় তার দিনকাল ভালোই কাটে। লোকজন চাপা গলায় বলাবলি করে সে নাকি ড্রাগের ব্যবসা করে।
ছেলেটি কানে আটকে রাখা একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে একটা ম্যাচের বাক্স থেকে একটা কাঠি বের করে ফস করে সিগারেটটা ধরিয়ে সিগারেটে টান দেয়। তারপর ধোয়াটা নাক দিয়ে বের করে সিগারেটটা বিজলীর দিকে এগিয়ে দেয়।
বিজলী মাথা নাড়ল, সে এখনো সিগারেট খাওয়া শুরু করে নাই। ছেলেটা সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম কী?
বিজলী বলল, বজলু।
তুই পারবি।
কী পারব?
মাইর পিট করতে।
বিজলী একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। সে মারপিট করতে পারবে এরকম প্রশংসা অন্যের মুখে শুনতে পাবে আগে কখনো কল্পনা করেনি।
ছেলেটা বলল, তোর সব ঠিক আছে। সাহস আছে। ফাস্ট আছস। খালি হাত চালাস মাইয়া মানুষের মতো।
বিজলী চমকে উঠল, ছেলেটা বলে কী? সে মেয়েদের মতো হাত চালায়? ছেলেটা বুঝে গেছে নাকি যে সে মেয়ে?
ছেলেটা তার সিগারেটে আরো একটা লম্বা টান দিল, তারপর বলল, তোর সমস্যা হচ্ছে মাইরের সময় তুই ঘুষি মারিস হাত দিয়া।
বিজলী একটু অবাক হয়ে বলল, ঘুষি তো হাত দিয়াই মারতে হয়।
উঁহু। ঘুষি দিতে হয় পুরা শরীর দিয়া। হাতটা খালি ব্যবহার করতে হয় ঘুষিটা জায়গা মতোন লাগানোর জন্য।