গাড়ির ভেতরে যারা বসে থাকে, বেশির ভাগ সময় তারা বিজলীর দিকে ঘুরে তাকায় না, এরকম হলে বিজলী তাদের সাথে বেশি সময় নষ্ট করে না, অন্য গাড়িতে চলে যায়। কেউ যদি তার দিকে তাকায় তাহলে সে আবার নতুন উৎসাহে তার বই বিক্রি করার চেষ্টা করে। গাড়িতে যদি ছোট বাচ্চা থাকে তাহলে বিজলী মা-বাবাকে না দেখিয়ে সরাসরি বাচ্চাটাকে বইগুলো দেখায়। কপাল ভালো হলে বাচ্চাগুলো বই কেনার বায়না ধরে বসে, ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। বাবা-মা তখন অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বই কিনে দেয়! বিজলী তখন বইগুলোর দাম অনেক বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলে–ঘ্যানঘ্যানে ধরনের বাচ্চা হলে তার লাভ।
দামি একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বিজলী তার বইটা নাড়াচাড়া করে, বলে, বাবু এই বইটা নিবে? দেখো
কী সুন্দর বই-কাঠঠোকরার ছবি দেখো! কাঠঠোকরা মানে উডপেকার, মাছরাঙা মানে কিংফিশার–
বাচ্চাটার মা জানালার কাঁচ নামিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে! বিরক্ত করো না। যাও–
বিজলী আজকাল এই ছেলে– শুনে চমকে ওঠে না। মনে হয় সে নিজেই ভুলে গেছে যে সে আসলে একটা মেয়ে। সে এখন পাকাপাকিভাবে ছেলে, তার নাম বজলু। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে আসার কয়েকদিন পর সুলতানা তাকে একদিন রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। যাবার আগে পথে-ঘাটে থাকার কিছু নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে গেছে। সুলতানার শেখানো নিয়মগুলো বিজলীর অনেক কাজে লেগেছে। পথে-ঘাটে থাকতে থাকতে সে নিজেও কিছু নিয়ম শিখেছে। প্রথম নিয়ম হচ্ছে বড়লোকদের গালাগাল ধৈর্য্য ধরে সহ্য করতে হবে কিন্তু পথেঘাটে তার মতো অন্যরা যারা থাকে তাদের গালাগাল ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা যাবে না–টিকে থাকার জন্য তখন তাকে পাল্টা গালাগালি, পাল্টা ধাক্কাধাক্কি কিংবা পাল্টা মারপিট করতে হবে। বিজলী সেই নিয়মটা মেনে চলছে, তার সাথে সাথে সে নিজেও আরো নতুন নতুন কিছু নিয়ম বের করেছে।
বিজলী এতদিনে জেনে গেছে যে সে পথেঘাটে যতদিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারবে। তবে বিজলী নিজে যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হচ্ছে নিজে না জেনেই সে ধীরে ধীরে কেমন জানি হিংস্র হয়ে উঠছে। পথেঘাটে বেঁচে থাকা অনেকটা জঙ্গলে থাকার মতো। জঙ্গলে বাঘ-ভালুকের মাঝে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে বাঘ-ভালুক হয়ে যেতে হয়। এখানেও তাই, পথে ঘাটে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে হিংস্র হয়ে যেতে হয়। কখনো হাল ছেড়ে দিতে হয় না।
কাজেই এবারেও বিজলী হাল ছাড়ল না। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো বাবু কত সুন্দর বই। তারপর একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিল, বিউটিফুল বুক! বিউটিফুল বার্ডস!
বিজলীর ইংরেজিতে কাজ দিল, বাচ্চাটা এবারে নাকি সুরে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিল, আম্মু বই কিনব! বই। হ্যাঁ এ্যা।
বাচ্চাটার মা ধমক দিয়ে বলল, অনেক বই আছে বাসাতে। আর বই লাগবে না।
বাচ্চাটা এবারে কাঁদতে শুরু করল, বই। বার্ডের বই। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ…
মা আরো জোরে ধমক দিল, চুপ। খবরদার কাঁদবে না।
বিজলী এবারে তার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করল, একটা বই জানালা দিয়ে সরাসরি বাচ্চাটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও! বাবু এই যে বই।
মা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে? এই ছেলে তোমাকে আমি বই দিতে বলেছি? বলেছি?
বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, না আন্টি। আমি বাবুকে এটা গিফট দিয়েছি।
বাচ্চাটির মা এবারে থতমত খেয়ে গেল, কী বলবে বুঝতে পারল না। বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, বাবুটা এত সুইট। এত মায়া লাগে। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, এনজয় দা বুক। তারপর ঘুরে পাশের গাড়ির দিকে চলে গেল, যদিও কান খাড়া করে রাখল। এই মহিলা একেবারে বাড়াবাড়ি ছোটলোক না হলে এখন তাকে ডাকবে। সত্যি সত্যি মহিলার গলা শোনা গেল। এবারে গলার স্বর যথেষ্ট নরম, এই ছেলে! এই ছেলে! বিজলী এবারে চেহারায় একটু বিব্রত ভাব ফুটিয়ে বলল, জি আন্টি।
তোমার বইয়ের দাম কত?
বিজলী জিবে কামড় দিয়ে বলল, না, আন্টি! এইটা বাবুর জন্যে গিফট। আমি দাম নিতে পারব না।
মহিলা তার ব্যাগ খুলে বলল, বলো কত দাম।
আন্টি, আপনার এত সুইট বাবুটাকে আমি গিফট দিতে পারব না? প্লিজ আন্টি! আমরা এই বইগুলো অনেক কমিশনে পাই।
তারপর মোক্ষম আরেকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করল, বিলিভ মি!
মহিলা ভুরু কোঁচকাল, তুমি লেখাপড়া করো।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি–এখন একটা ঝামেলার মাঝে আছি, তাই বন্ধ আছে। আবার শুরু করব।
তোমার ফ্যামিলি?
কেউ নাই। যারিনা সাইক্লোনে সবাই ভেসে গেছে।
মহিলা এবারে জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় নোট বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিল। বিজলী মাথা নিচু করে বলল, থ্যাংক ইউ আন্টি। কিন্তু আমি সত্যি বাবুকে এই গিফটটা দিয়েছি। আমরা রাস্তাঘাটে থাকি, আমাদের কোনো আপনজন নাই। মাঝে মাঝে আমাদেরও তো কাউকে গিফট দিতে ইচ্ছে করে।
মহিলাটি এবারে পুরোপুরি দ্রবীভূত হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নাও থোকা। আমি তোমার বইয়ের দাম দিচ্ছি না। আমিও তোমাকে গিফট দিচ্ছি।
বিজলীর হঠাৎ করে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, সে ছোটখাটো অভিনয় করে মহিলাকে এভাবে নরম করে দিয়েছে। এটা একধরনের প্রতারণা। সে আগে তো এরকম প্রতারক ছিল না, পথে থাকতে থাকতে সে প্রতারণা করা শিখে গিয়েছে। বিজলী কেমন যেন কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।