বিজলী আবার থতমত খেয়ে গেল, বিজলী একটা সুন্দর নাম হতে পারে? তার মা সব সময় বলেন, তাকে এই নামটা দেওয়াই ভুল হয়েছে, এই নাম দেওয়ার জন্যই সে নাকি সব সময় এত যন্ত্রণা করে।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অন্য ভাইবোনদের কী নাম? ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোন?
ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের সাথে বিজলীও হেসে ফেলল, বলল, না স্যার। আমার খালি একটা ছোট ভাই আছে তার নাম খোকন।
স্যার বললেন, ভেরি গুড! ভেরি গুড!
বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কোনটা ভেরি গুড। তার ছোট ভাই থাকাটা নাকি তার নাম ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোনের বদলে খোকন হওয়াটা। যেটাই হয়ে থাকুক সে আর মাথা না ঘামিয়ে বসে পড়ল।
স্যার হাসি হাসি মুখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার খুব ভালো লাগছে যে তুমি ছোট একটা মেয়ে কিন্তু তোমার এত সুন্দর এনালিটিকেল মাইন্ড। যে জিনিসটা কখনো আমার মাথায় আসেনি কিন্তু তুমি সেই প্রশ্নটা করেছ। তুমি কখনো লেখাপড়া বন্ধ করো না। অবশ্যই পড়াশোনা করবে, ডিগ্রি নেবে। ঠিক আছে?
বিজলীর একবার মনে হলো সে জিজ্ঞেস করে এনালিটিকেল মাইন্ড কথাটার মানে কী। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে তার লজ্জা লাগল, তাই শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করল না। সে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে স্যার।
সে মুখে বলেছে ঠিক আছে, কিন্তু আসলে এটা মোটেও ঠিক নেই। তার পড়াশোনা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ক্লাসে স্যার পড়াতে শুরু করেছেন বিজলী মন দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু একটু পরে পরে সে আনমনা হয়ে যেতে লাগল।
.
ছুটির ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে ক্লাস থেকে বের হতে শুরু করল। বিজলীও তার বই-খাতাগুলো বুকে চেপে ধরে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। এই স্কুলে আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই একজন অন্যজনকে চেনে। সে আসে বহুদূর একটা চর থেকে, কেউ তাকে চেনে না। তাকে আলাদা করে ক্লাসে কেউ কখনো লক্ষ করেনি কিন্তু আজকে সবাই তাকে আলাদাভাবে লক্ষ করল, তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমনকি একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল, বিজলী তোমার বাড়ি কোন গ্রামে?।
বিজলী বলল, আমার বাড়ি অনেক দূর। কাজলডাঙ্গা চর।
মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বলল, কাজলডাঙ্গা চর? ইয়া আল্লাহ! সেইটা তো অনেক দূর!
বিজলী মাথা নাড়ল, হ্যাঁ অনেক দূর।
প্রত্যেকদিন সেইখান থেকে আস?
হ্যাঁ।
জোয়ারের সময় পানিতে রাস্তা ডুবে যায় না?
হ্যাঁ ডুবে যায়। সেই জন্যেই তো জোয়ার-ভাটা হিসাব করে আসতে হয়। দেখো না, মাঝে মাঝে আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যায়?
আরেকজন বলল, ইয়া মাবুদ।
কথা বলতে বলতে তারা স্কুল থেকে বের হয়ে এল, এখন তাকে হেঁটে হেঁটে কাজলডাঙ্গা চরে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এখনো কমপক্ষে দুই ঘণ্টা! বিজলী একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল, যদি তাদের চর থেকে আরো কেউ এই স্কুলে আসত তাহলে দুজনে মিলে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যেতে পারত। এতটা পথ একা একা হেঁটে যেতে তার কেমন জানি লাগে।
স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পেছন থেকে বিজলী ডাক শুনতে পায়, বিজলীবু! বিজলীবু!
বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে পেল স্কুলের সামনে যে বিশাল বটগাছ তার মোটা একটা শিকড়ের ওপর খোকন বসে আছে। বিজলী চোখ কপালে তুলে বলল, খোকন? তুই এইখানে?
খোকন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ বিজলীবু! তুমি এত দেরি করছ? আমি কখন থেকে বসে আছি!
আমি দেরি করছি? এই মাত্র না ছুটি হলো। তুই কোন সময় থেকে বসে আছিস?
দুপুর থেকে?
বাড়ি যাস নাই? এইখানে চলে আসছস?
হ্যাঁ।
কেন? বাড়ি যাস নাই কেন?
খোকন লাজুক মুখে বলল, ভাবলাম তোমার লগে এক সাথে যাই।
কেন? কিছু হইছে স্কুলে?
খোকন মুখ টিপে হাসল, বলল, হ্যাঁ।
বিজলী জিজ্ঞেস করল, কী হইছে?
আমি একটা প্রাইজ পাইছি।
সত্যি? বিজলী চোখ বড় বড় করে বলল, কী প্রাইজ?
আজকে স্কুলে সবাইরে রচনা লিখতে দিছে। আমারটা সবচেয়ে ভালো হইছে সেই জন্যে আমারে প্রাইজ দিছে। ফাস্ট প্রাইজ!
বিজলী আনন্দে কী করবে বুঝতে পারল না, খোকনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ফাস্ট প্রাইজ? ফাস্ট প্রাইজ!
হ্যাঁ।
কী দিছে প্রাইজ?
একটা বই।
দেখি বইটা দেখা। দেখা তাড়াতাড়ি।
খোকন তখন তার বইগুলোর ভেতর থেকে একটা বই বের করে আনল, বইয়ের নাম ছোটদের মহাপুরুষ। প্রচ্ছদে অনেকগুলো মহাপুরুষের ছবি।
বিজলী বইটি এমনভাবে হাতে নিল যে দেখে মনে হতে পারে সে একটা বই হাতে নিচ্ছে না, অমূল্য কোনো সম্পদ হাতে নিচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখে বইয়ের পাতা ওল্টাল, প্রথম পৃষ্ঠায় হাতে লেখা, প্রথম পুরস্কার : রচনা প্রতিযোগিতা, তারপর খোকনের নাম। বিজলী বইয়ের আরো পৃষ্ঠা ওল্টাল। ভেতরে অনেক মহাপুরুষের ছবি আর জীবন কাহিনী।
বিজলী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার ছোট ভাইটির দিকে তাকালো, আনন্দে দাঁত বের করে হাসল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরল।
ঠিক তখন তাদের পাশ দিয়ে তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বিজলী তখন খোকনকে ছেড়ে দিয়ে ঐ ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, এই যে খোকন। আমার ছোট ভাই। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পাইছে!
ছেলেমেয়েগুলো বিজলীর কথা শুনে প্রথম একটু অবাক হয়ে যায়, কিন্তু তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলে, সত্যি? কী প্রাইজ পাইছে?