খাওয়া শেষ হবার পর খোকন একটুখানি পায়েশ খেলো। তারপর আবার একটুখানি টিভি দেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কী নরম একটা বিছানা, মনে হয় বিছানার মাঝে সে ডুবে যাবে। খোকনের নতুন মা বাতি নিভিয়ে দিল। জানালা দিয়ে হালকা একটা আলো আসছে, এই আলোতে সবকিছুকে কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। শুয়ে শুয়ে সে দেখে এক পাশে একটা এসি থেকে কুলকুল করে ঠান্ডা বাতাস বের হচ্ছে। ঘরের ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা। খোকন নরম একটা কম্বল শরীরের উপর টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করল। খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে সব সময় বিজলীবুয়ের সাথে ঘুমাত–ঘুমের মাঝে সে বিজলীবুয়ের ওপর পা তুলে দিত, বিজলীবু কখনো সেজন্যে বিরক্ত হতো না! ছোট একটা বিছানায় দুজনে গাদাগাদি করে ঘুমাত–কিন্তু এখন বিজলীবুয়ের কথা কিছুতেই মনে করা যাবে না। কিছুতেই মনে করা যাবে না। হঠাৎ খোকনের মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।
গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে গেল। খোকনের ঘর থেকে অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কাঁদছে। মিলি একটু ভয় পেয়ে বিছানা থেকে নেমে খোকনের ঘরে এল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল খোকন বিছানায় ছটফট করছে, তার মুখ থেকে যন্ত্রণার মতো একধরনের শব্দ হচ্ছে।
মিলি ঘরের লাইট জ্বালাল, খোকন তার মাথা এপাশ ওপাশ করছে। চোখ আধখোলা, কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। মিলি প্রায় ছুটে গিয়ে মশারি তুলে খোকনকে জড়িয়ে ধরল, তাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, বাবা সোনা আমার, কী হয়েছে?
খোকন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে ছটফট করে, কান্নার মতো শব্দ করে। মিলি তাকে বুকে চেপে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে সোনা?
খোকন চোখ খুলে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, পানি! পানি! পানি আসছে। ভাসিয়ে নিবে, ভাসিয়ে নিবে–
কোথায় পানি? মিলি নরম গলায় বলল, পানি নেই সোনা। পানি নেই। আমি আছি।
খোকন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? বি–বি– বিজলীবু বলতে গিয়ে খোকন থেমে গেল। বিজলীবুয়ের কথা বলা যাবে না। কিছুতেই বলা যাবে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে।
মিলি বুকে চেপে ধরে বলল, আমি তোমার মা।
খোকন মিলিকে চেপে ধরে বলল, ভয় করে মা। আমার খুব ভয় করে।
মিলি একধরনের শিহরণ অনুভব করে। তার এই সন্তানটি তাকে মা বলে ডেকেছে।
ভয় নেই বাবা, তোমার কোনো ভয় নেই।
খোকন কাঁপা গলায় বলল, মা, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?
না বাবা। মিলির চোখে পানি চলে এল, খোকনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, না বাবা, আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না। কোনোদিন ছেড়ে যাব না।
খোকন দেখল তার বিজলীবু আস্তে আস্তে নতুন মা হয়ে যাচ্ছে। বিজলীবু বলে এখন কেউ নেই, এখন আছে তার মা। তার এই মা এখন তাকে বুকে চেপে রাখবে।
.
ঠিক তখন বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। স্টেশনের মেঝেতে তার বয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সাথে সে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ করে একটা পুলিশ এসে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে বিজলী অন্য বাচ্চাদের সাথে ছুটতে থাকে। পুলিশ যেন তাকে ধরতে না পারে। কিছুতেই যেন ধরতে না পারে।
*
সেলিনা তীক্ষ্ণ চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন?
আমি কী বলেছি আপনি শুনেছেন। ছেলেটিকে এডপশানে দেয়া হয়েছে।
সেলিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, বোনটিকে ভাই থেকে আলাদা করে ফেলেছেন?
বোন বড় হয়ে গেছে। তাকে কে এডপশানে নেবে?
সেলিনা প্রায় চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমি কি পরিষ্কার করে বলিনি দুই ভাইবোনকে আলাদা করা যাবে না। কিছুতেই আলাদা করা যাবে না?
আমাদের রেকর্ডে সে রকম কিছু নেই। নাজনীন ড্রয়ার থেকে কিছু কাগজ বের করে সেলিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বিশ্বাস না হলে দেখেন।
সেলিনা কাগজগুলো দেখার কোনো আগ্রহ দেখাল না। একটু ঝুঁকে নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা এখন কোথায় আছে?
সেটা বলা যাবে না। যাদেরকে এডপশানে দিই তাদের ঠিকানা কাউকে বলার নিয়ম নেই। সরি।
সেলিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করল, আর মেয়েটি?
মেয়েটি? নাজনীন হাসির মতো শব্দ করল, বলল, শি ইজ আ ক্রিমিনাল। তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশে? সেলিনা কী বলবে বুঝতে পারল না।
নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, আমি গত সপ্তাহে খোঁজ নিয়েছিলাম, সে কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ইনোসেন্ট অসহায় কিছু বাচ্চা দেবেন। আপনি তা না দিয়ে আমাকে হার্ডকোর ক্রিমিনাল ধরিয়ে দিয়েছেন? কেমন করে এটা করতে পারলেন?
সেলিনা চোখ বড় বড় করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না, সে কী একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে, নাকি একটা রাক্ষুসীর দিকে তাকিয়ে আছে।
*
রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলো ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। বিজলী হাতের বইগুলো নিয়ে গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। বইগুলো বাচ্চাদের জন্যে লেখা, রংচঙে বই, তাই যে গাড়িতে বাচ্চারা থাকে সেই গাড়িতে বিজলী বইগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে রাখায় তার কথা গাড়ির ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায় কি না সে জানে না, তারপরও সে চেষ্টা করে, জানালার কাছে মাথা লাগিয়ে বলে, আন্টি একটা বই নিয়ে যান আপনার বাবুর জন্য। কী সুন্দর বই দেখেন। বিজলী যখন বই বিক্রি করার চেষ্টা করে তখন যতটুকু সম্ভব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে, শুধু তাই না মাঝে মাঝে একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পাখির বই আছে, মাছের বই আছে, ফলের বই আছে। কী সুন্দর বই, বিউটিফুল বুক! আপনার বাবু সব পাখির নাম শিখে যাবে। এই দেখেন মাছরাঙা পাখি, কিংফিশার, কী সুন্দর রং দেখেন–একটা বই নিয়ে যান আন্টি!