সে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় তার নতুন মা বাথরুমে উঁকি দিল, বলল, বাবা, দাঁড়াও আগেই কাপড় পরো না। আমি তোমার শরীরে একটু লোশন মাখিয়ে দিই!
তখন খোকন দাঁড়িয়ে রইল, আর তার নতুন মা তার সারা শরীরে আদর করে লোশন মাখিয়ে দিল। সাইক্লোনের রাতে তার সারা শরীর ফালা ফালা করে কেটে গিয়েছিল, এখনো তার শরীরে সেই দাগ আছে। তার নতুন মা সেই দাগগুলোতে চুমু খেয়ে বলে, আহারে! আমার সোনা কত কষ্ট করেছে।
খোকন কিছু বলে না। তার নতুন মায়ের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। আবার ভালোও লাগে। তার নতুন মা তাকে এত আদর করে–আর কেউ তাকে এরকম আদর করে নাই। বিজলীবু ছাড়া–আবার বিজলীবুয়ের কথা মনে হতেই থোকনের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। কাউকে সে বিজলীবুয়ের কথা বলতে পারবে না! কাউকে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে, মাথার ভেতরে আবার সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। তার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে থাকে।
খোকনের নতুন মা বিষয়টা লক্ষ করে, তখন তাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখে, মাথায় হাত বুলায়। হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, ভয় কী সোনা? ভয় কী? আমরা আছি না তোমার সাথে?
খোকন মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। তার নতুন মা আছে তার সাথে। তার ভয় নাই। বিজলীবুয়ের কথা যদি কাউকে না বলে তাহলে বিজলীবুয়েরও কোনো ভয় নাই।
পরিষ্কার কাপড় পরে সে তার মায়ের সাথে খেতে বসে। তার নতুন মা প্লেটে খাবার তুলে দেয়। যখন চরে ছিল তখন খাওয়ার কিছু ছিল না। ভাত আর ছোট মাছ। না হলে শুঁটকি। বড়জোর অর্ধেকটা ডিম–এখন কত কী খাবার। প্রত্যেকদিন মাছ আর গোশত থাকে। কী আশ্চর্য!
তার নতুন মা তাকে সবজি খেতে দেয়, সবজি খেলে শরীরের কত উপকার হয় সেগুলো বলে! খাওয়ার পর দই না হলে মিষ্টি থাকে। বিজলীবু মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করত–খোকন জোর করে তার মাথা
থেকে বিজলীবুয়ের চিন্তাটা সরিয়ে দিল, না হলে আবার তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাবে।
খাবার পর খোকন তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসে। ইংরেজি বইগুলো সে এখনো পড়তে পারে না, শুধু ছবি দেখে। বাংলা বইগুলো সে পড়ে। কী মজার মজার বই! অ্যাডভেঞ্চারের বই। ভূতের বই। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়বে সে ঠিক করতে পারে না।
বই পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার নতুন মা বিকেলবেলা তাকে ডেকে তুলেছে। বিকেলবেলা ঘুমিয়ে গেলে যখন ঘুম ভাঙে তখন সবকিছু অন্যরকম মনে হয়। আজকেও খোকনের সবকিছু অন্যরকম মনে হলো। সে কোথায় আছে কেন আছে সেটা বুঝতেই তার অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। যখন বুঝল সে কোথায় আছে তখন তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল, বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল।
খোকনের নতুন মা তাকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেল, নিজেই তার হাতমুখ ধুয়ে দিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে এল। সেখানে ডাইনিং টেবিলে বসে খোকন একটুখানি অরেঞ্জ জুস খেলো। ছোট থাকতে একবার সে কমলা খেয়েছিল, কিন্তু কমলা চিপে যে রস বের করে সেই রস খাওয়া যায় সেটা সে জানতই না।
খাওয়ার পর কাপড় জামা বদলে তার নতুন মা তাকে নিয়ে বের হলো। তাকে একটা কারাটে স্কুলে নিয়ে সেখানে তাকে ভর্তি করে দিল। খোকন এর আগে কখনো কারাটে স্কুল দেখেনি, তার বয়সী ছোট ছোট বাচ্চা সাদা কাপড় পরে হাইয়া হাইয়া করে হাত-পা ছুড়ছে, দেখে খোকনের কেমন যেন হাসি পেয়ে যায়।
সন্ধ্যেবেলা খোকন বসে বসে তার হোমওয়ার্ক করল। অল্প কয়েকটা হোম ওয়ার্ক, দেখতে দেখতে সেগুলো করা হয়ে গেল। তখন সে বসার ঘরে তার নতুন মায়ের পাশে বসে টেলিভিশন দেখল। সে যখন চরে থাকত তখন সে টেলিভিশনের নাম শুনেছিল কিন্তু কখনো টেলিভিশন দেখেনি। এখন তার নিজের বাসায় কত বড় টেলিভিশন। কী সুন্দর তার রং। খোকন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
টেলিভিশনে খোকন বসে একটা কার্টুন দেখল, একটা বিড়াল একটা ইঁদুরকে নানাভাবে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনোই ধরতে পারে না। ইঁদুরটার অনেক বুদ্ধি, সব সময় বিড়ালটাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। দেখে খোকনের হাসি পেয়ে যায়।
খোকন যখন বসে বসে টেলিভিশন দেখছিল তখন রায়হান এসে ঢুকল। রায়হান তার নতুন বাবা। খোকনকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, ইয়াংম্যান! কেমন আছো তুমি? তোমার নতুন বাসা কেমন লাগছে?
খোকন বলল, ভালো।
রায়হান তার হাতের ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে একটা ফুটবল বের করে সেটা সে খোকনের দিকে ছুঁড়ে দিল। খোকন দুই হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলে। রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, গুড ক্যাচ! তুমি ফুটবল খেলো?
খোকন মাথা নাড়ল, বলল, খেলি!
সে যখন চরে থাকত তখন চরের ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলত। তাদের অবশ্যি ফুটবল ছিল না। একটা জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে ফুটবল খেলত। খোকন হাতের ফুটবলটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! সত্যিকারের ফুটবল, কেমন জানি একটা চামড়া চামড়া গন্ধ। তার নতুন বাবা গতকালকেও তার জন্যে একটা রঙের বাক্স এনেছে, আজকে একটা ফুটবল। প্রত্যেকদিনই তার জন্যে নতুন একটা উপহার, কী আশ্চর্য!
ওরা তিনজন মিলে রাতের খাবার খেলো। খোকন অবাক হয়ে দেখল ভাতগুলো কী সুন্দর ধবধবে সাদা, কী সুন্দর তার ঘ্রাণ। মনে হয় শুধু লবণ দিয়েই সে ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে। খোকনকে অবশ্য শুধু লবণ দিয়ে খেতে হলো না। টেবিলে আছে ইলিশ মাছের ভাজা, গরুর গোশত আর ডিম ভুনা। সাথে ঘন ডাল। ডাল খাওয়ার সময় খোকনের মনে পড়ল, যখন চরে থাকত তখন তার মা তাদের জন্যে পাতলা জিলজিলে এক ধরনের ডাল রাঁধত।