সুলতানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আয় হাঁটি। এই জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।
বিজলী বলল, হ্যাঁ। যদি বুঝে যায় তাহলে হইচই শুরু হয়ে যাবে।
কাল সকালের আগে কেউ বুঝবে না। রাত্রে কেউ খেয়াল করবে না।
সুলতানা আর বিজলী রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে, অনেক রাত তারপরেও মাঝে মাঝেই একটা দুইটা চায়ের দোকান খোলা।
হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার পাশে একটা ময়লা ফেলার ঢিবি পেল। সুলতানা তখন তার পলিথিনের ব্যাগটা সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, এখন আর কেউ আমাগো খুঁইজা পাবে না।
বিজলী বলল, শুধু বাথরুমে গেলে বুঝে যাবে আমরা বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইর হইছি।
সুলতানা বলল, উহঁ। আমি রডটা আবার সোজা করে দিয়া আসছি, দরজাটাও খুলে আসছি। কেউ বুঝতে পারবে না আমরা কোন দিক দিয়া পালাইছি।
বিজলী বলল, কী মজা।
সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, বিশাল একটা হাউকাউ লাইগা যাবে। মনে হয় এক দুইজনের চাকরিও চইলা যাবে!
সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি?
সুলতানা আপন মনে কিছুক্ষন হাসল। তাকে দেখে মনে হলো কারো চাকরি চলে যাওয়াটা বিশাল একটা আনন্দের ব্যাপার। একটু পরে বলল, আয় বজলু যাই। মনে আছে তো, তুই এখন থেকে বজলু।
বিজলী বলল, হ্যাঁ সুলতান ভাই। মনে আছে।
তারপর দুজন পুরোপুরি একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
*
স্কুল থেকে বের হয়েই খোকন দেখল মিলি দাঁড়িয়ে আছে। খোকনের নতুন মা। সে অবশ্যি এখনো মিলিকে মা বলে ডাকা শুরু করেনি। তার কেমন জানি লজ্জা করে। খোকন বুঝতে পারছে তার নতুন মা খুব করে চাইছে সে যেন তাকে মা বলে ডাকে, কিন্তু এখনো সে কিছু না ডেকে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে।
খোকনকে দেখে মিলি এগিয়ে এলো, তার হাত ধরে বলল, খোকন সোনা, তোমার স্কুলটা আজকে কেমন ছিল?
খোকন বলল, ভালো।
আজকে তার দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন থেকে অনেক ভালো তবুও আজকেও পুরো সময়টা তার ভয় ভয় লেগেছে। স্কুলের সব ছেলেমেয়ে সুন্দর সুন্দর স্কুলের পোশাক পরে এসেছে। তারও সুন্দর পোশাক। ধবধবে সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট, গলায় টাই। টাইটা গলায় কীরকম জানি ফাঁসের মতো আটকে থাকে, গলায় একটু খসখস করে, এছাড়া কোনো সমস্যা নাই। স্কুলের স্যার ম্যাডামেরা কেউ বকাবকি করে না, সব সময় আদর করে কথা বলে। সবাই অবশ্যি ইংরেজিতে কথা বলে। সেজন্যে কে কী বলছে বুঝতে তার সমস্যা হয়। মিলি বলেছে কয়দিন পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।
মিলি জিজ্ঞেস করল, তোমার নাশতা খেতে পেরেছিলে?
খোকন মাথা নাড়ল। সে যখন চরে থাকত তখন শুধু ভাত খেয়েছে। ভাতের সাথে শুঁটকি মাছ। কখনো কখনো শাক কিংবা ডাল। নাশতা বলে যে কিছু আছে সে জানতই না। মিলিদের বাসায় এসে সে আবিষ্কার করেছে কত হাজারো রকম নাশতা আছে। বেশির ভাগ খাবারের সে নামই জানে না, আর খেতে কী মজা! কিন্তু প্রত্যেকবার নাশতা খাবার সময় তার বিজলীবুয়ের কথা মনে পড়ে। তখন তার কান্না পেয়ে যায়, সে আর খেতে পারে না। বিজলীবুয়ের কথা সে কাউকে বলতে পারবে না, যখনই সেটা মনে পড়ে তখনই তার কেমন জানি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে আসে।
মিলি খোকনের হাত ধরে বলল, চলো, বাসায় যাই।
খোকন বলল, চলো।
মিলিদের ড্রাইভার তাদের নীল রঙের গাড়িটার দরজা খুলে দাঁড়াল। প্রথমে খোকন গাড়িতে উঠল, তারপর মিলি। গাড়ির ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা!
গাড়ি করে খোকন তার নতুন মায়ের সাথে তার নতুন বাসায় যেতে থাকে। তাদের চরে গাড়ি দূরে থাকুক একটা রিকশাও ছিল না। হেঁটে হেঁটে বাজারে গেলে সেখানে রিকশা কিংবা টেম্পো দেখা যেত। প্রথম গাড়ি দেখেছে হাসপাতালে এসে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে যখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত তখন দেখত রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। ছোট-বড় নানা রকম গাড়ি, নানা রকম শব্দ। এখন সে নিজেই প্রত্যেকদিন গাড়ি করে স্কুলে যায়। এটা তার নতুন মা আর নতুন বাবার গাড়ি। তার মানে এটা তার গাড়ি। খোকনের কী অবাক লাগে, কয়দিন আগে তার কিছু ছিল না, এখন তার সবকিছু আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, স্কুল আছে। কিন্তু তার বাবা নাই, মা নাই, বিজলীবু নাই। বিজলীবুর কথা মনে হতেই তার বুকের মাঝে জানি কেমন করতে থাকে, তার মাথার মাঝে কেমন জানি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বিজলীবুয়ের কথা কাউকে বলা যাবে না। কাউকে বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে। খোকনের শরীরটা হঠাৎ কাঁপতে থাকে।
খোকনের নতুন মা খোকনের দিকে তাকালো, তারপর আদর করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কী হয়েছে সোনা আমার? তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নাই। খোকন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমার কিছু হয় নাই।
মিলি আদর করে খোকনকে জড়িয়ে ধরে রাখে। এইটুকুন একটা বাচ্চা না জানি কত বড় কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। মিলির বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে।
বাসায় এসে খোকন গোসল করল। তার কী সুন্দর বাথরুম, উপর থেকে বৃষ্টির মতো পানি পড়ে। পানিটাকে গরম করা যায় আবার ঠান্ডা করা যায়। গোসল করার সময় নব ঘুরিয়ে খোকন পানিটাকে কুসুম কুসুম গরম করে নেয়। কত রকমের সাবান, চুলের জন্য কত রকম শ্যাম্পু! কী সুন্দর গন্ধ। গোসল করতে কী আরাম। গোসল করে সে বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর মোছে। নরম তুলার মতো তোয়ালে, জিলজিলে গামছার মতো না! গোসল শেষ করে ধোয়া কাপড় পরে নেয়, প্রত্যেকদিন নতুন ধোয়া কাপড়! কী আশ্চর্য, সে জানতই না গোসল করে প্রত্যেকদিন নতুন কাপড় পরতে হয়।