বিজলী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি জানতা এখান দিয়ে বের হওয়া যায়?
সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, অনেক দিন ঠেলাঠেলি করে এইটা ছুটাইছি। আয় যাই। তুই আগে যাবি নাকি আমি?
বিজলীর বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল, বলল, আমি যাই?
যা।
জানালা দিয়া বাইর হওয়ার পর পয়লা কার্নিশের উপর দাঁড়াবি, তখন তোর হাতে এই আমি পলিথিনের পোটলাটা দিমু। তুই সেইটা সাবধানে নিচে ফেলে দিবি।
কী আছে পোটলার ভিতরে?
সময় হলেই দেখবি। তারপর তুই নামবি। সাবধান, শব্দ করিস।
ঠিক আছে।
বিজলী জানালার ফুটো দিয়ে সাবধানে বের হয়ে এল, শরীরটা নিচু করে সে সাবধানে কার্নিশের উপরে দাঁড়াল। ভেতর থেকে তখন সুলতানা তার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। বিজলী সুলতানার কথামতো ব্যাগটা সাবধানে নিচে ফেলে দিল। তারপর কার্নিশ ধরে ঝুলে পড়ে নিচে নেমে এল।
কয়েক মিনিটের মাঝেই সুলতানাও নিচে নেমে এল। সুলতানা ব্যাগটা হাতে নিয়ে সাবধানে একটু এগিয়ে যায় তারপরে দেয়ালের আড়ালে একটা জায়গায় ব্যাগটা রেখে ফিসফিস করে বলল, বস!
আমরা বাইর হব না?
বাইর হইবার আগে রেডি হইতে হবে।
কীভাবে রেডি হবে বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু কোনো কথা না বলে সে বসে পড়ল। এর মাঝেই সুলতানের উপর তার অনেক বিশ্বাস জন্মে গেছে। তার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে শুধু, মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ একজন এসে তাদেরকে ধরে ফেলে।
সুলতানাকে অবশ্যি মোটেও নার্ভাস দেখা গেল না। সে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাচি বের করল। সেটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, নে। কেটে দে।
বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী কাটব?
চুল। আমার চুল কাইটা দে। দেখে যেন মনে হয় ছেলে।
বিজলীর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, তারপর জিজ্ঞেস করল, চুল কাইটা দেব? ছেলেদের মতো করে?
হ্যাঁ। এইখান থেকে মাইয়া হয়ে বের হওয়া খুব বিপদের। আমরা যখন বাইর হমু তখন আমরা দুইজনই ছেলে হয়ে বাইর হমু। তোর নাম বিজলী তুই হইয়া যাবি বজলু। আমি হমু সুলতান।
হঠাৎ করে বিজলী বুঝতে পারল সুলতানা কেন শার্ট আর প্যান্ট চুরি করেছে।
সুলতানা বলল, দেরি করিস না। কাট।
বিজলী কাঁচিটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কখনো চুল কাটি নাই!
তোর চুল কাটা জানতে হবে না। খালি ছোট করে দে।
সুলতানার মাথা ভর্তি চুল, কাটতে বিজলীর মায়া লাগছিল তারপরও নিষ্ঠুরের মতো সে তার সুন্দর চুলগুলো কাটল। কাটার পর দেখা গেল মাথা ভর্তি খোঁচা খোঁচা চুল, এখানে সেখানে খাবলা খাবলা চুল উঠে আছে। দেখে বিজলীর খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু সুলতানা একটুও মাথা ঘামাল না। কাটা চুলগুলো সে একটা পলিথিনের ব্যাগে যত্ন করে তুলে রাখল। তারপর কাঁচিটা হাতে নিয়ে বিজলীকে বলল, আয় এখন তোরটা কাইটা দিই।
বিজলী নিজের মাথাটা এগিয়ে দিল, সুলতানা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চুল কাটতে লাগল। কিছুক্ষণের মাঝেই বিজলীর মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে!
চুল কাটা শেষ হলে তারা নিজেদের কাপড় বদলে শার্ট প্যান্ট পরে নিল। বিজলী ভেবেছিল তারা এই ঢলঢলে শার্ট প্যান্ট পরেই থাকবে কিন্তু সুলতানা কাঁচি দিয়ে প্যান্টগুলো হাঁটুর উপরে কেটে হাফ প্যান্টের সাইজ করে ফেলল। বিজলী দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করতে চেষ্টা করল, কিন্তু সুলতানা ধমক দিয়ে বলল, আমাগো বয়সের ছেলেরা এই রকম ঢলঢলা প্যান্ট পরে না।
শুধু যে প্যান্টটা কেটে ছোট করল তা না, শার্টগুলোর হাতাও কাটল এবং নিচেও কেটে ছোট করে নিল। তারপর নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, আয় যাই।
বিজলী জিজ্ঞেস করল, দেয়াল পার হবা কেমনে! উপরে কাঁচ দিয়া রাখছে দেখছ?
জানি! তুই আমার সাথে আয়।
বিজলী সুলতানার পিছু পিছু গেল, সুলতানা দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে একটা জায়গায় থেমে গিয়ে উপরে তাকাল। তারপর থেমে গিয়ে বলল, এইখানে।
এইখানে কী?
এইখানে কাঁচগুলো ভাইঙা রাখছি। কিন্তু উপরে কিছু একটা বিছাইতে হবে।
কী বিছাবা?
আমাগো কাপড়গুলা। আমি একটা তোয়ালেও আনছি।
অন্ধকারে দুইজন দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল। সুলতানা বলল, প্রথমে আমি উঠি। তুই এখানে দাঁড়া। আমি তোর ঘাড়ে উঠুম। আমাকে ঘাড়ে নিতে পারবি তো?
পারব।
তুই দেয়ালটা ধরে বস।
বিজলী দেয়ালটা ধরে বসল। সুলতানা বিজলীর ঘাড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, এখন তুই আস্তে আস্তে খাড়া।
বিজলী নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়ালটা ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়াল। সুলতানা তার ব্যাগ থেকে তাদের কাপড়গুলো, তোয়ালেটা বের করে দেয়ালের উপর রেখে ধারালো কাঁচগুলো ঢেকে ফেলল। তারপর হাতে ভর দিয়ে উপরে উঠে গেল।
সাবধানে একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে সুলতানা তার হাতটা নিচে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখন তুই উইঠা আয়।
বিজলী সুলতানার হাত ধরল, সুলতানা তখন তাকে উপরে টেনে তুলতে থাকে। বিজলী দেয়ালের এবড়ো থেবড়ো জায়গায় পা রেখে অন্য হাত দিয়ে টেনে নিজেকে ওপরে তুলে ফেলল।
সুলতানা খুশি হয়ে বলল, কাম হয়া গেছে। এখন নামতে হবে।
অন্য পাশে লাফিয়ে নামার জন্য দেয়ালটা একটু বেশি উঁচু, তারপরও বিজলী সাহস করে লাফ দিল। সুলতানা তার হাতে তাদের পোটলাটা ধরিয়ে দিয়ে সহজেই লাফ দিয়ে নেমে এল। একটা ছোট নালা পার হয়ে তারা রাস্তায় উঠে আসে।
টুং টাং শব্দ করে একটা রিকশা আসছে, বিজলীর মনে হলো এখনই দৌড়ে তাদের কোথাও লুকিয়ে যেতে হবে, কিন্তু সুলতানা একটুও উত্তেজনা না দেখিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রিকশাওয়ালা গুন গুন করে একটা গান গাইতে গাইতে চলে গেল, তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকালো না।