কী রাস্তা?
আমার সাথে যদি যাস তাহলে বলব।
বিজলী মাথা নাড়ল, তার সাহস হয় না। এইখানে মাথার ওপর একটা ছাদ আছে, দুই বেলা খাবার আছে। যদি কোনোভাবে সেলিনা জাহানের নাম ঠিকানা জোগাড় করে তাকে একটা চিঠি লেখা যায় তাহলে সেলিনা আপা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবে। এখান থেকে পালিয়ে সে কোথায় যাবে? কী করবে?
.
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজলী ঠিক করল সেও সুলতানার সাথে পালিয়ে যাবে। মেয়েদের এই আশ্রয়কেন্দ্রটা আসলে ভয়াবহ একটা জায়গা। প্রতি রাতেই সেখানে ভয়ানক ঘটনা ঘটে, পুরুষ মানুষ ঢুকে মেয়েদের টানাটানি করে। চিৎকার-চেঁচামেচি হতে থাকে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে, মারামারি করে। যদি সেরকম কিছু নাও হয় তবু বিজলী ঘুমাতে পারে না। এখানকার সবগুলো মেয়ের জীবনে একধরনের ভয়ংকর কষ্ট আছে, তারা সারাদিন সেগুলো নিজেদের মাঝে চেপে রাখে কিন্তু গভীর রাতে যখন ঘুমিয়ে যায় তখন ঘুমের ভেতর সেগুলো তাদের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। ঘুমের মাঝে এক একজন ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। বিড়বিড় করে কথা বলে। রক্তশীতল করা গলায় চিৎকার করে ওঠে। সে নিজেও নিশ্চয়ই এরকম কিছু করে, কারণ কয়েক রাতে সুলতানা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে, বলেছে চিৎকার বন্ধ করতে।
বিজলী যখন সুলতানাকে বলল, সেও তার সাথে পালিয়ে যাবে তখন সুলতানা কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পরে কিন্তু আমারে দোষ দিতে পারবি না।
দিব না।
মনে রাখবি, মানুষ কিন্তু খুব খারাপ।
বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।
লুতুপুতু হলে এক রাতও টিকতে পারবি না। কিন্তু তুই মারপিট করতে পারিস–তুই পারবি। সেই জন্যে তোরে বলেছি।
বিজলী একটু হাসল, সে কখনোই চিন্তা করেনি যে সে মারপিট করতে পারে, একদিন সেরকম একজন মানুষ হিসাবে পরিচিত হবে।
.
আশ্রয়কেন্দ্রের মেয়েদের দিনে একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বিল্ডিং থেকে বের হতে দেয়। বাইরে খোলা জায়গায় তখন তারা হেঁটে বেড়াতে পারে। পুরো কম্পাউন্ডটা বড় দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গেটে তালা মারা থাকে, তাই এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। মেয়েরা তখন কেউ কেউ মাটি কুপিয়ে গাছের চারা লাগায়, সেখানে পানি দিয়ে গাছগুলো বড় করে। কেউ বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কেউ হাঁটাহাঁটি করে। কমবয়সী কয়েকজন টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া খেলে। আশ্রয়কেন্দ্রের একজন মানুষ এক কোনায় একটা টুলে বসে তাদের পাহারা দেয়।
এর মাঝে সুলতানা একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট চুরি করে ফেলল। কোনো একজন মানুষ সেগুলো ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিল। কেউ যখন লক্ষ করছে না তখন সুলতানা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে প্রথমে শার্টটা টেনে এনে তার কামিজটা উপরে তুলে শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। তারপর ধীরে-সুস্থে ঘরের ভেতর গিয়ে সেটা খুলে এসে একই কায়দায় প্যান্টটাও শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। বিজলী বুঝতে পারল না সুলতানা পুরুষ মানুষের শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে। সুলতানাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবা?
সুলতানা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, সময় হলে দেখবি।
কিছুক্ষণের মাঝেই শার্ট এবং প্যান্ট চুরি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ধরা পড়ল। যে মানুষটির শার্ট-প্যান্ট চুরি হয়েছে সে এখানে রান্না করে। মানুষটি ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করল এবং সুলতানা তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তার চেঁচামেচিটি উপভোগ করতে থাকে। শুধু তাই না, কে চুরি করে থাকতে পারে একটু পরে পরেই সেটা নিয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এখানে যে মেয়েরা থাকে তাদের অনেকেই চুরি চামারি করে এখানে এসেছে, তবুও কেউই কোনো মেয়েকে সন্দেহ করল না। একটা মেয়ে পুরানো শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে?
পরের দিন একই কায়দায় সুলতানা দুই নম্বর শার্ট আর প্যান্টটাও চুরি করল। সেটা যখন ধরা পড়ল তখন কম্পাউন্ডের ভেতর একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ভেতরে যে কয়জন পুরুষ মানুষ থাকে তাদের একজন আরেকজনকে সন্দেহ করে বড় ধরনের ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। আরেকটু হলে একটা মারামারি শুরু হয়ে যেত, অনেক কষ্টে সেটাকে থামানো হলো। পুরো সময়টাতে মানুষগুলোর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সুলতানা ব্যাপারটা উপভোগ করছিল!
.
দুদিন পর গভীর রাতে সুলতানা বিজলীকে নিয়ে পালিয়ে গেল।
সেই রাতে ঘুমানোর সময়ও বিজলী অনুমান করেনি যে আজকেই তারা পালিয়ে যাবে। গভীর রাতে সুলতানা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে ফিস ফিস করে বলল, আয়, যাই?
বিজলী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনখানে?
পালাব।
এখন?
হ্যাঁ। এখন। আয়। বলে সে বিজলীর জন্যে অপেক্ষা না করে অন্ধকারে হাঁটতে থাকে।
বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সুলতানার পিছু পিছু যেতে থাকে। ঘরের বাইরে বিশাল কলাপসিবেল গেটে বড় বড় তালা, সুলতানা কীভাবে বের হবে বিজলী বুঝতে পারল না। সুলতানা অবশ্যি বাইরের দরজার দিকে গেল না, করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে হাজির হলো।
বিজলীকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে সুলতানা বাথরুমের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। গ্রিলের রড ধরে ঝাঁকুনি দিতেই একটা রড বাঁকা হয়ে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, এখন এর ভেতর দিয়ে সহজেই একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারবে।